নতুন বে-টার্মিনাল প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
চট্টগ্রামে বিদেশি অর্থ বিনিয়োগে নির্মাণাধীন 'বে-টার্মিনাল' -ফাইল ছবি
ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনের মুখে সদ্য পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ব্যক্তি স্বার্থে নেওয়া বিভিন্ন বিলাসী প্রজেক্টের অন্যতম ছিল 'বে-টার্মিনাল' নির্মাণ কার্যক্রম। কিন্তু স্বৈরশাসকের পতন হলেও স্বার্থান্বেষী একটি মহল বিদেশি অর্থ বিনিয়োগের নামে চট্টগ্রামে 'বে-টার্মিনাল' নির্মাণের পাঁয়তারা করছে। অথচ বাস্তব অবস্থা হলো সরকারি ও বেসরকারি মিলে বর্তমানে যে জেটিগুলো কার্যকর ও নির্মাণাধীন আছে, সেগুলোর মাত্র ৫০% ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বাইরে থাকা অর্ধেক জেটিই অব্যবহৃত অলস পড়ে থাকে। ফলে এরইমধ্যে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে বর্তমানে যে জেটিগুলো কার্যকর ও নির্মাণাধীন আছে, আগে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা হোক। চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন জেটির সংখ্যা ১৭টি, যার মধ্যে ১১টি কনটেইনার জেটি, বাকি ৬টি বাল্ক কার্গো জেটি। এছাড়াও সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চালু জেটিগুলোর মধ্যে রয়েছে- পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের ডলফিন ওয়েল জেটি, গ্রেইন সাইলো জেটি, সিমেন্ট ক্লিংকার জেটি, টিএসপি জেটি ও ঈটঋখ জেটি। আর ড্রাই ডকের জেটির মধ্যে আছে কঅঋঈঙ টৎবধ জেটি, ঊধংঃবৎহ জবভরহবৎু খঃফ (ঊজখ), পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসমূহের নিজস্ব জেটি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ড্রাইডকের দুটি জেটি, যা ১১ মিটার ড্রাফট পর্যন্ত জাহাজ হ্যান্ডলিং করতে পারে। উপরস্তু প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী সি পোর্টের ২টি জেটি, গঅজঊঝক খরহবং এর লাল দিয়ার চরে ৪টি এবং সরকারি অনুমোদনের পর নির্মাণাধীন কর্ণফুলী ড্রাইডকের ৪টিসহ বন্দরের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আরও ৩৭টি ও ৬টি নির্মাণাধীনসহ চট্টগ্রামে মোট জেটির সংখ্যা ৪৩টি। ২০১৯-২৩ সালের দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ১১টি কনটেইনার জেটি ও ৬টি কার্গো জেটি দিয়ে গড় হিসাবে বছরে ৩.৩ মিলিয়ন টিইইউ এবং ০৬ কোটি টন বাল্ক কার্গো হেন্ডলিং করা হলেও আন্তর্জাতিক রিসেশনের প্রেক্ষিতে বাৎসরিক মালামাল ওঠানামার সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বন্দরে জাহাজ আগমনের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পায়। একইসঙ্গে কনটেইনার এবং বাল্ক কার্গোর চাহিদা নিম্নগামী হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭টি জেটির মধ্যে সবসময়ই দুই-চারটি জেটি অলস অবস্থায় বসে থাকে। অনুরূপ সিমেন্ট ক্লিংকার, ড্রাইডক এবং কর্ণফুলী জেটিসহ অন্যান্য জেটিসমূহও কার্গোর অভাবে খালি পড়ে থাকে। তাছাড়া পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (চঈঞ)'র ৩টি জেটি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও সচরাচর জাহাজের দেখা মেলে না। এমতাবস্থায় গঅজঊঝক খরহবং এর জেটি চালু হলে বন্দর ৪০% কনটেইনার কার্গো হারাবে। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারিপর্যায়ে অনুমোদিত জেটিগুলোর কার্যকর, আংশিক নির্মাণাধীন এবং কিছু নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা জেটিগুলো পূর্ণভাবে চালু হলে দেশের বাৎসরিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি হবে যথাক্রমে চট্টগ্রাম বন্দরের- ৩.৩ মিলিয়ন, গঅজঊঝক খরহব- ২.০ মিলিয়ন, কর্ণফুলীর- ২.০ মিলিয়ন ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের- ১.০ মিলিয়ন। অর্থাৎ মোট ৮.৩ মিলিয়ন ঞঊটং। এই ৮.৩ মিলিয়ন টিইইউ ক্যাপাসিটিসম্পন্ন জেটিগুলোর চাহিদা ১০০% মেটাতে আরও ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। মাতারবাড়ী ডিপ সি পোর্ট যেখানে ১৪ থেকে ১৬ মিটার ফববঢ় ফৎধভঃ এর জাহাজ ভিড়তে পারবে বলে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেটি চালু হলে আরও ০৩ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি যোগ হবে। ফলে দেশের কনটেইনার জেটিগুলোর বাৎসরিক মোট হ্যান্ডলিং ক্ষমতা হবে প্রায় ১১.৩ মিলিয়ন টিইইউ, যার ১০০% চাহিদা মেটাতে বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনায় কমপক্ষে আরও ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। এদিকে কেয়ারটেকার সরকার যেহেতু ব্যয়বহুল প্রকল্প বাদ দিতে বলেছে, সেই অবস্থায় বে-টারমিনালের মতো অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প যার অর্থনৈতিক সূচকসমূহ ওজজ, ইঈজ কোনোভাবেই ইতিবাচক নয় এবং যেটা গ্রহণ করলে জবয়ঁরৎবফ চড়ৎঃ ঈযধৎমবং এত বেশি হতে পারে, যার কারণে বাংলাদেশ আঞ্চলিক দেশসমূহের বন্দরগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে, যেটা জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বৈ কিছুই নয়। বন্দরের একজন, কনজারভেটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আপনারা যারা বে-টার্মিনালের মতো এত বড় প্রজেক্ট দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে আদৌ লাভজনক হবে কি না মর্মে সঙ্কিত, তাদেরকে বলব, এ-জাতীয় প্রজেক্ট যত বড় ব্যবসা বা উপার্জনও ততই বড় হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে; বর্তমান পরিস্থিতিতে এ জাতীয় প্রজেক্ট সময়ানুগ কি না? বিশেষ করে কৃত্তিমভাবে বিলম্বিত করে ব্যয় বাড়ানো হবে কি না? বিশেষ করে ঐ সমুদ্র সীমানায় নাব্যতা সংকট কীভাবে দূর নয়, মোকাবিলা করবে সেটাই বড় ব্যাপার। খেয়াল করবেন, আমি নাব্যতা দূর না বলে মোকাবিলার কথা বলছি। আমাদের এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমার কোথাও কোথাও মৌসুমভেদে নাব্যতা সংকটের তীব্রতা ও স্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে নাব্যতা সংকট সাধারণত চিরতরে দূর হয় না। আর এখানেই বড় রকম বাজেটের ব্যাপার রয়েছে।' অন্যদিকে এত বড় প্রজেক্ট করার সময় সবার আগে আসে পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনীয় তথা উপযুক্ত নদী শাসনের ব্যাপারটিও। প্রোপারলি করলে এটাও ব্যয়বহুল। এসব কিছুই নির্ভরশীল আমাদের ফান্ড এবং চলমান বন্দর ও সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য জেটিগুলো ব্যবহার হচ্ছে কি না? বিশেষ করে মাতারবাড়ীর মতো বড় প্রজেক্ট শেষ তথা বন্দর চালু না করে আরেকটায় হাত দিব কি না এবং অর্থায়ন কারা করবে? ইত্যাদির ওপর। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এই খাতে অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারটিও বন্দরের জন্য নিরাপদ কি না এটাও কর্তৃপক্ষের চিন্তা করতে হবে। \হ বাস্তব অবস্থা যখন এতটাই ভয়াবহ, অর্থাৎ যখন দেশের বিদ্যমান জেটিগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, বন্দর ও অন্যান্য সরকারি এবং বেসরকারিপর্যায়ে জেটির জন্য বিনিয়োগকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার যেখানে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে, যেখানে দেশের কনটেইনার কারগো ও বাল্ক কারগোর বর্তমান ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চাহিদা অনুপাতে বিদ্যমান জেটির সংখ্যা ও ক্যাপাসিটি যেহেতু অনেকগুণ বেশি এবং সাধারণ বিবেচনায়ও এটি পরিষ্কার যে, বর্তমানে বন্দরের জেটি ও অন্যান্য বিদ্যমান ও নির্মাণাধীন জেটিসমূহের ১০০% চাহিদা মেটাতে আরও ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় ঝুঁকির ব্যাপার হচ্ছে 'বে-টার্মিনালের বিশাল জায়গাজুড়ে দ্রম্নত পলি পড়ার কারণে যতই ড্রেজিং করা হোক না কেন, দীর্ঘ মেয়াদে নাব্যতা সংকট দূর করা প্রায় অসম্ভব। ফলে এই প্রজেক্টটি কোনোভাবেই টেকসই হবে না। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয়ই শার হবে। এদিকে বে-টার্মিনাল প্রস্তুত হলে চট্টগ্রাম পোর্টে জাহাজ আসার পরিমাণ খুব দ্রম্নতই হ্রাস পাবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। উপরস্তু বর্তমান বন্দর নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে বৎসরে যে ২ থেকে ২.৫০ হাজার কোটি টাকা উপার্জন করছে, বে-টার্মিনাল নির্মাণ হলে বন্দর সেই উপার্জনও হারাবে। অর্থাৎ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশি অপারেটরদের হাতে চলে যাবে। ফলে হুমকির মধ্যে পড়তে পারে ঐতিহ্যবাহী এই বন্দরের টিকে থাকাই। এবং কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে এর ২০ হাজার কর্মী। এখানে উলেস্নখ্য যে, সম্প্রতি বিশেষজ্ঞ এবং কনসালটেন্টস 'বে টারমিনালের ব্যাপারে যতগুলো সমীক্ষা করেছেন তার সবগুলোই নেতিবাচক। অতএব আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী চক্রের হাত থেকে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর বাচানোসহ জনস্বার্থে এবং জাতীয় স্বার্থে প্রস্তাবিত 'বে-টার্মিনাল' নির্মাণ কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করার জোর দাবি সংশ্লিষ্টদের।