শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১
বিদু্যৎ ও জ্বালানি

বিদেশি চার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত

এই চার প্রতিষ্ঠান হলো- ভারতের এইচ এনার্জি, রাশিয়ার গ্যাজপ্রম, চীনের সিনোপেক এবং উজবেকিস্তানের এরিয়েল
রেজা মাহমুদ
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বিদেশি চার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত

বিদু্যৎ ও জ্বালানি সরবরাহে করা বিশেষ আইনে বিদেশি চার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যদিও এসব চুক্তি একেবারেই চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। গত ৫ আগস্ট সরকার পতন না হলে এসব চুক্তি এতদিন সম্পন্ন হতো বলে জানায় জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা। মূলত বিশেষ আইন ২০১০ স্থগিত হওয়ায় এবং চুক্তির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিদেশি এই চার প্রতিষ্ঠান হলো- ভারতের এইচ এনার্জি, রাশিয়ার গ্যাজপ্রম, চীনের সিনোপেক এবং উজবেকিস্তানের এরিয়েল। জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, বিগত সরকার বিদু্যৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের (বিশেষ আইন) আওতায় এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার এই আইন স্থগিত করায় নতুন করে এর আওতায় কোনো চুক্তি সাক্ষর করবে না, এমনকি আগের চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। ফলে পাইপলাইনে থাকা বিশেষ আইনে এই চুক্তিগুলো বাতিল হচ্ছে।

শেষ মুহূর্তে চুক্তি সই না হওয়া এসব প্রকল্পের ব্যাপ্তি ছিল অনেক বড়। এতে রাষ্ট্রের এসব প্রকল্পে জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হতো। জ্বালানি বিশ্লেষক ও এ খাতের সাবেক কর্মকর্তাদের মতে, সাবেক সরকার বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতকে অর্থ লুটপাটের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে নিয়েছিল। তা না হলে এমন জন-বিরোধী আইন কেউ করে না। দেশ ও মানুষের স্বার্থের কথা না ভেবে মোটা অংকের কমিশন বাণিজ্য করতেই নিজেদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে বিনা শর্তে প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়েছে। এর ফলে দেশের বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো

\হলাখো কোটি টাকার দেনা বয়ে বেড়াচ্ছে। এই লুটের অর্থ এখন পরিশোধ করছে সাধারণ মানুষ।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র মতে, রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ভোলায় পাঁচটি গ্যাস কূপ খনন, এইচ এনার্জির সঙ্গে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি এবং আমদানি করা এলএনজি সরবরাহে বাংলাদেশভিত্তিক কোম্পানি দীপন গ্যাসের সঙ্গে ভোমরা থেকে খুলনা পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল।

এ ছাড়া, সিলেটে পাঁচটি গ্যাস কূপ খনন করার জন্য চীনের সিনোপেক এবং ছয়টি কূপ খনন ও অন্যটিতে ওয়ার্কওভারের কাজ করার জন্য উজবেকিস্তানের এরিয়েলের সঙ্গে আলোচনা চলছিল।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, দেশের বিদ্যমান গ্যাস কূপগুলোর উৎপাদন আরও বাড়াতে ওয়ার্কওভার বসানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছি, সেখানে চুক্তির জন্য কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। অন্যদিকে গ্যাজপ্রম, সিনোপেক এবং এরিয়েলের সঙ্গে স্থলভাগে ১৭টি কূপ খননের চুক্তিও চূড়ান্ত ছিল। সে ক্ষেত্রেও চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে মানা হয়নি কোনো নিয়ম। ছিল না কোনো টেন্ডার।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ ৪৬টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল সাবেক সরকারের। এসব কূপ খননের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হবে। এরই অংশ হিসেবে ১৭টি কূপে কার্যক্রম চালাতে বিদেশি এই তিন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়।

এদিকে এর আগেই বিশেষ আইনে মোট ২০টি কূপ খনন করেছে গ্যাজপ্রম। এই চুক্তি হলে নতুন করে কোনো দরপত্র ছাড়াই আরও পাঁচটি কূপ খনন করত তারা। আর এই খনন বাবদ ১২০ মিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করে গ্যাজপ্রম। অন্যদিকে এই চুক্তি আওতায় ভারতের এইচ এনার্জি থেকে বছরে ০.৮ এমটিপিএ থেকে ১ এমটিপিএ (মিলিয়ন টন পার অ্যানাম) এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল সাবেক সরকারের। গত ২৭ জুলাই ভারতের এইচ এনার্জির সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি (জিএসএ) বিষয়ে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় চলমান আন্দোলনের কারণে বৈঠক আর হয়নি। তবে এর আগে গত এপ্রিলে পেট্রোবাংলার চেয়ম্যান জেনেন্দ্র নাথ সরকার ভারতের এইচ এনার্জির সঙ্গে আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে জানিয়েছিলেন।

অন্যদিকে চীনা কোম্পানি সিনোপেকের সঙ্গে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিএফসিএল) আওতাধীন পাঁচটি কূপ খনন নিয়ে আলোচনা চলছিল। কূপগুলো হলো- রশীদপুর-১১ ও ১৩, কৈলাশটিলা-৯ এবং সিলেটের ডুপি টিলা-১ আর একমাত্র উন্নয়ন কূপ সিলেট-১১। এসব প্রকল্পে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল। উজবেক কোম্পানি এরিয়েল বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে সাতটি কূপ খননের জন্য আলোচনা শেষ পর্যায়ে ছিল। যার ব্যয় ধার হয়েছিল ১৩১ মিলিয়ন ডলার।

এদিকে বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে সমালোচিত আইনের একটি 'বিদু্যৎ ও জ্বালানি দ্রম্নত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন ২০১০'। মূলত এই আইনের মাধ্যমেই কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়াই উচ্চ দামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার বৈধতা নেওয়া হয়। এই আইনের করা চুক্তি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না, এমনকি কেউ কোনো তথ্য জানতে চাইলে সরকার তা গোপন করার ক্ষমতা রাখবে। তবে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরই প্রকাশ্যে আসতে থাকে এই আইনের করা অসম বিভিন্ন চুক্তি তথ্য ও সীমাহীন দুর্নীতির চিত্র।

তবে এখন উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আগ্রহী কোম্পানি বাছাই করে নতুন করে চুক্তি করা হবে বলে যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম। যথাযথ নিয়ম মেনে যাতে দেশের স্বার্থ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায় এমন দরপত্র প্রদানকারীর সঙ্গেই চুক্তি সাক্ষর করা হবে। ইতোমধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়াও যেসব চুক্তি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে, সেসব চুক্তি গঠিত কমিটি পর্যালোচনা করবে বলেও তিনি জানান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে