ছেলের রক্তের রং মিলিয়ে এখন লাল কাপড় পরি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ আকাশকে নিয়ে মায়ের স্মৃতিচারণ

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ম গাফফার খান চৌধুরী 'ছেলের তাজা রক্তের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লাল কাপড় পরি। অনেকে অনেক কথা বলেন। তাতে কি! লাল কাপড় পরলে ছেলের স্মৃতি মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করে। মনে হয়, ছেলে আমার বেঁচেই আছে। হয়তো খানিকটা পরে এসেই মা বলে ডাক দেবে। একমাত্র সন্তানের জন্যই বহু কষ্টে ভাত বিক্রি করে ঢাকায় ছিলাম। ছেলে একদিন অভাব ঘুচাবে, সেই আশায়। সেই আশাই যেহেতু নিভে গেছে, তাই আমিও চিরতরে গ্রামে চলে যাচ্ছি। যদিও গ্রামে কোনো জমি বা ঘর নেই, তাই ভাইদের দয়ায় বসবাস করতে হবে। সরকার যদি একটু থাকার ব্যবস্থা করতো, কষ্ট কিছুটা হলেও কমতো।' কথাগুলো বলছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ মো. ইমন হোসেন আকাশের (২২) মা বেবী। আকাশ তার পরিবারের সঙ্গে ঢাকার পলস্নবী থানাধীন ১১ নম্বর সেকশনের বি বস্নকের ১ নম্বর সড়কের ৩৬ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ২/বি নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন। শনিবার দুপুরে তাদের বাসায় উপস্থিত হলে পরিচয় পেয়ে কথা বলতে রাজি হন আকাশের মা। এরপর বলতে থাকেন জীবনের নানা কাহিনী। তিনি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী আমার জন্ম ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি। পিতার নাম জয়নাল বেপারী। মায়ের নাম আনোয়ারা বেগম। বাড়ি শরীয়তপুর জেলার জাজিরার নদীভাঙন প্রবণ এলাকায়। আমরা ৫ বোন। ভাইও আছে দুই জন। নদীতে বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাওয়ায় জীবিকার তাগিদে ৩০ বছর আগে আমি ঢাকায় আসি। এরপর বসবাস শুরু করি পলস্নবী এলাকায়। ঢাকায় আসার কয়েক বছর পরেই বিয়ে হয়। বিয়ে করি মো. মতিউর রহমান নামের শরীয়তপুরের এক যুবককে। সংসার চলছিল ভালোই। আকাশের বয়স যখন এক বছর, তখন ওর বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যান। বিয়ে করেন আরেকটি। সেই ঘরে তিন কন্যা ও দুই ছেলে আছে। আমি একমাত্র ছেলে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করিনি। স্বামী চলে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়ি। ছোট ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন বাসায় বাসায় কাজ করতে থাকি। কিন্তু বাচ্চা নিয়ে কাজ করাটা অনেকেই পছন্দ করতেন না। তাই বাসা বাড়ির কাজ ছেড়ে দেই। এরপর ব্যাচেলরদের বাসায় কাজ করতে থাকি। পরবর্তীতে সে কাজও ছেড়ে দেই। গত ১১ বছর ধরে ভাড়ায় এই ফ্ল্যাটে বসবাস করছি। বর্তমানে ভাড়া মাসিক ১৫ হাজার টাকা। কোনোভাবেই সংসার চালাতে পারছিলাম না। তাই বাসার দুটি রুম ব্যাচেলরদের কাছে মাসিক ৮ হাজার টাকায় ভাড়া দেই। এক রুমে ছেলেকে নিয়ে থাকতাম। আর ব্যাচেলরদের রান্না করে খাওয়াতাম। প্রতি বেলা খাওয়ার জন্য ৫০ টাকা করে পেতাম। এভাবেই সংসার চলছিল কোনোমতে। এক পর্যায়ে আমার কষ্ট দেখে ছেলেও সংসার চালাতে ডেলিভারিম্যানের কাজ নিল। মোডাস নামের একটি কোম্পানির হয়ে বিভিন্ন জায়গায় কসমেটিকস সামগ্রী সরবরাহ করত। মাসে ১৮ হাজার টাকা বেতন পেত। সবমিলিয়ে ভালোই চলছিল। আকাশ মিরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ জার্মান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে ভোকেশনালে এসএসসি পাস করেছিল। পাশাপাশি স্থানীয় একটি কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিল। এরপর তিনি আর কথা বলতে পারছিলেন না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর বললেন, সব শেষ হয়ে গেল চলতি বছরের ৪ আগস্ট। ওইদিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে পলস্নবী থানাধীন মিরপুর অরিজিনাল-১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে প্রধান সড়কে মিছিল করছিল। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে মিছিলকারীদের হটাতে বৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এক পর্যায়ে ছেলে আমার বুলেটে ঝাঝরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই একমাত্র ছেলের মৃতু্য হয়। রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকে সেখানেই। মৃতু্যর সময় পানির জন্য ছটফট করছিল বলে অন্যদের কাছে শুনেছি। কিন্তু সেখানে এত গুলি হচ্ছিল যে, যাওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না। পরে ছাত্ররা তার লাশ ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাদের খবর দেওয়া হয়। আমরা পাগলের মতো ছুটে যাই। গিয়ে দেখি সব শেষ। \হছেলে আমার রক্তের নদীতে ডুব দিয়ে গোসল করে শুয়ে আছে। পুরো শরীর রক্তে ভেজা। আমার আর কিছুই মনে নেই। পরে হুশ ফিরলে দেখি আমি ও আমার একমাত্র কলিজার টুকরা ছেলের লাশ বাসার সামনে। কোনো প্রকার পোস্টমর্টেম ছাড়াই বুলেটবিদ্ধ লাশ রাতেই নিয়ে রওনা দিতে বলা হয় গ্রামের বাড়িতে। পরদিন ৫ আগস্ট ছেলের লাশ দাফন করা হয়। তিনি ক্রিকেট খেলার বিভিন্ন ট্রফি বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ছেলে আমার ক্রিকেট খুব ভালোবাসত। ভালো খেলত ক্রিকেট। অনেক পুরস্কারও পেয়েছে। এখন সবই স্মৃতি। ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে আমার আর কিছুতেই মন বসে না। কোনো কাজই মনোযোগ দিয়ে করতে পারি না। শুধু ছেলের কথাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ছেলের মোবাইলটিই এখন সম্বল। মোবাইলে ছেলের নানা ধরনের ছবি আছে। সেখানে উপস্থিত শহীদ আকাশের দুই খালা বলছিলেন, আপাকে আকাশের মোবাইল ফোন সাধারণত আমরা দেই না। কারণ মোবাইল হাতে নিয়ে কাঁদতে থাকে। অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন আপা। অনেকটাই পাগলের মতো তার চলাফেরা। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না। বাসায় গিয়ে দেখা গেল, তিনি লাল জায়নামাজে বসে নামাজ আদায় করলেন। সেটি পাশেই রাখা। লাল টুকে টুকে কাপড় পরিধান করে কথা বলছিলেন। খাটের বিছানার চাদর থেকে শুরু করে সবই প্রায় লাল রংয়ের। কারণ জানতে চাইতেই তিনি পাগলের মতো হাসতে থাকেন। তিনি আরও বলেন, আমি ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকেই লাল রং খুবই পছন্দ করি। জানি না, কি কারণে লাল রং খুবই ভালো লাগে। এ নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে। তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। কারণ ছেলেকে যখন দেখেছি, মনে হয়েছে লাল রংয়ের রক্তের নদীতে গোসল করে এসেছে। পুরো শরীর লাল। তাই ছেলের কথা স্মরণ করে লাল কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে যত কিছু ব্যবহার করা যায়, সবই লাল রঙয়ের ব্যবহার করার চেষ্টা করি। এতে ছেলের স্মৃতি যেন মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করে ওঠে। মনে হয় ছেলে আমার বেঁচে আছে। হয়তো আশপাশেই আছে। এসেই মা বলে ডাক দেবে। এই বলেই তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন। বার বার কাঁদছিলেন, আবার স্বাভাবিক হয়ে কথা বলছিলেন। বলছিলেন, যে ছেলের জন্য জীবনে এত কষ্ট করেছি। যে ছেলে বড় হয়ে কষ্ট ঘুচাবে বলে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে ঢাকায় থেকেছি। সেই ঢাকা শহরই আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে। ছেলে আমার শুধু ঢাকা নয়, পুরো পৃথিবী ছেড়ে পরপারে চলে গেছে। তাই আমি একলা মানুষ ঢাকায় থেকে কি করব। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি চিরদিনের জন্য গ্রামে চলে যাব। যদিও গ্রামে থাকার মতো কোনো জায়গা বা জমি নেই। ভাইদের দয়ায় থাকতে হবে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, যদি একটু থাকার জায়গা করে দিত, তাহলে হয়তো মনের কষ্ট কিছুটা হলেও কমতো। এই বলেই তিনি আবার হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকেন। এভাবেই কথাবার্তায় কেটে যায় অনেক সময়। শেষে ঢাকার পলস্নবী থানায় আকাশ হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কিছুই বলতে পারবো না। ভালো করে আমার কিছু মনেও নেই। তবে মামলাটি একজন উকিল সাহেব লিখে এনে আমাকে দিয়ে সই করিয়েছেন। মামলায় উলিস্নখিত ঠিকানার সঙ্গে বর্তমান ঠিকানার কোনো মিল না থাকার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য মোতাবেক মামলা হয়েছে। মামলায় যে ঠিকানা দেওয়া আছে, ওই ঠিকানা মোতাবেক আমি ভোটার হয়েছিলাম। যদিও আমি ১১ বছর আগে ওই বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করছি। মামলার বাদী হিসেবে তার নামের পাশাপাশি কোনো যোগাযোগের নম্বর না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি মূর্খ মানুষ। আমি কি আর এত কিছু বুঝি। যারা শিক্ষিত মানুষ, আমার হয়ে মামলা করেছেন, তাদের বা মামলা নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তার উচিত ছিল আমার মোবাইল নম্বর লিখে রাখা। যাতে করে আমার সঙ্গে পুলিশ বা অন্যান্য মানুষ যোগাযোগ করতে পারে। আপনার মতো অনেকেই একই অভিযোগ করেছেন। অনেকে তো বাসার ঠিকানাই খুঁজে পাইনি বলে বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছি। আপনি তো তবুও হাল না ছেড়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুরে ঠিকই বাসা বের করেছেন। অনেকে হয়তো তাও করবে না। সরকারের তরফ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাওয়া না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মাঝে মাঝে পুলিশের কিছু সদস্য শুধু আমাদের ফোন করে আকাশকে কোথায় কবর দিয়েছি, তা জানতে চায়। এখন পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। সাহায্য সহযোগিতা তো দূরের কথা। আমাদের খবরও কেউ রাখে না। একমাত্র কিছু সাংবাদিক অনেক কষ্ট করে আমাদের ঠিকানা বের করে কথা বলেছেন। আর কেউ আসেনি। যে আন্দোলনের কারণে ছেলে মারা গেল, সেই আন্দোলনেরও কেউ আসেননি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বলুন তো একজন নারীর নাম শুধু বেবী হতে পারে? আমার ভালো নাম ফাতেমা বেগম। আবার অনেকে বেবী আক্তার নামেও চিনেন। অথচ জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার নাম শুধু বেবী। যিনি ভোটার তালিকা করতে এসেছিলেন, তিনি আরেক জনের কাছে নাম শুনেই বেবী লিখে দিয়েছেন। সেই থেকে আমার ফাতেমা বেগম ও বেবী আক্তার নাম মরে গেছে। এখন আমি শুধুই বেবী। আক্ষেপ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমার কষ্টের আর শেষ নেই। ছেলে মারা যাওয়ার পর আগের স্বামী আমার কাছে ফেরত এসেছে। তবে সাময়িক সময়ের জন্য। আমার স্বামী মিরপুর-১১ নম্বর মেঘনা ব্যাংকের একটি এটিএম বুথের নাইটগার্ড হিসেবে চাকরি করেন। সকাল সাতটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ডিউটি। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৭ আগস্ট ঢাকার পলস্নবী থানায় শহীদ আকাশের আবাসস্থল পলস্নবী ১১ নম্বর সেকশনের বি বস্নকের ৩ নম্বর লাইনের ৩ নম্বর বাড়ির ঠিকানা উলেস্নখ করে একটি হত্যা দায়ের হয়। মামলা নম্বর-১৫। মামলাটির বাদী আকাশের মা বেবী। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ৬৩৭ জনের নাম উলেস্নখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে।