গ্রীষ্মের ছুটি, কোটা আন্দোলন, ছাত্র-জনতার অভু্যত্থান; নানা ঘটনায় দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস বন্ধ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। টানা সাড়ে তিন মাসেরও বেশি সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি স্থবির হয়ে পড়েছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্মিলিত কর্মকান্ডে মুখর পরিবেশ।
দীর্ঘ সময়ের অস্থিরতা কাটিয়ে রোববার থেকে ফের ক্লাসে ফিরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ক্লাসে ফিরতে পারায় কলা, সামাজিক বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন অনুষদ ঘুরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেছে। তবে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে।
রোববার সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের শ্যাডোয় শিক্ষার্থীদের ভিড় জমেছে। বটতলা ও কলাভবন ফটকের সিঁড়িতে অনেকে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডার আসরে মজেছেন।
শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পূরণে 'পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে' জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেছেন, 'নতুন বাংলাদেশে ১১২ দিন পর ক্লাস শুরু হলো। সামনে বড় মাপের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ক্লাস গ্যাপ পূরণে পরিকল্পনা আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, সেসব নিরসনে কাজ চলছে।'
এ বিষয়ে সবার সহযোগিতা চেয়ে উপাচার্য বলেন, 'শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে। সেসব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। আশা করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবকিছু সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে চলবে।'
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার মধ্যে গত ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেইসঙ্গে খালি করা হয় হলগুলো।
এরপর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পরদিন আবাসিক হলসহ ক্যাম্পাস খুললেও এতদিন স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম দেখা যায়নি।
এর মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলে উপাচার্য, প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষ ও ডিনদের পদত্যাগের হিড়িকে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; এসব পদে নতুনদের আনা হয়েছে ধাপে ধাপে।
ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন হলে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আসন বণ্টনের কাজও চলছে।
ক্লাসে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগের ছাত্রী রিজিয়া পারভীন বলেন, 'সব বাধা অতিক্রম করে আমরা ক্যাম্পাসে নতুন মুক্ত পরিবেশে সকালে এসেছি। ক্লাস একটা হয়েছে। বেশ ভালো লাগছে।'
সব বিভাগে দ্রম্নত ক্লাস শুরু হবে বলে আশা করছেন জাপানিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান শামীম। তিনি বলেন, 'সরকার পতনের পর নতুন করে হলে সিট বরাদ্দ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পরিবেশ দেখে খুশির আমেজ বয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনেকটা চাপে পড়েছে চতুর্থ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা। অনেক ডিপার্টমেন্টে ক্লাস শুরু হয়েছে আবার কিছু ডিপার্টমেন্টে ক্লাস শুরু হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করি, দ্রম্নতই ক্লাস শুরু হবে এবং ক্যাম্পাস আগের মতো প্রাণবন্ত অবস্থায় ফিরবে।'
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাইশা মালিহা বলেন, তাদের বিভাগের ক্লাস শুরু হবে সোমবার থেকে। এই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, 'ভিসি স্যার বলেছিলেন তার প্রধান কাজ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করা। অবশ্যই আমাদের দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করা উচিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোসহ ডিপার্টমেন্টগুলোতে এখনো অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে।'
আবাসন সংকট নিয়ে মালিহা বলেন, 'হলগুলোতে প্রথম বর্ষসহ অনাবাসিক অনেক নারী শিক্ষার্থীই বৈধ সিটের দাবিদার। তাদের চাহিদা অনুযায়ী সিটের ব্যবস্থা না করে ক্লাস শুরু করে দেওয়া হলে তাদের আবাসন সংকটে পড়তে হবে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টগুলোতে নীল দলের শিক্ষকদের অপসারণের যে দাবি উঠেছে, তার মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করে একাডেমিক কার্যক্রমকে পূর্ণ গতিতে সচল করাটা কঠিন হবে।' তবে প্রশাসনকে নিজস্ব গতিতে কাজ করতে দিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
একই বিভাগের মাস্টারদা সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী তাশাহুদ আহমেদ রাফিম বলেন, 'আন্দোলন সংগ্রামের এই দেশে চিন্তাভাবনা পরিষ্কার থাকার জন্য পড়ালেখা চলমান থাকা জরুরি। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস শুরু হলেও আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। জুলাইয়ের বিপস্নবের সময় থেকেই আমরা মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছি। সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নিজেদের জীবনে ব্যস্ত হওয়া জরুরি।'
এদিকে, ছুটির পরপরই চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের। আটকে থাকা এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে এদিন।
যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুর ব্রহমান শহীদ বলেন, 'আমাদের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ছুটির পরই। এখন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রথম দিন থেকেই আমাদের পঞ্চম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।'
এদিকে সকালে সড়কে যানজট পোহাতে হলেও ক্লাসরুমে ঢোকার স্বস্তি পেয়েছেন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী জুনায়েদ আহমেদ। তিনি বলেন, 'প্রচন্ড যানজট সকাল বেলায়, ভ্যাপসা গরম। তার মধ্যে একটা মানসিক শান্তি যে, আমরা ক্লাস করতে পেরেছি।'
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা 'মানসিক ট্রমায়' ছিলেন বলে জানিয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ হল ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাজমুল হক।
তিনি বলেন, 'দ্রম্নত ক্লাসে ফেরাটা জরুরি ছিল। ক্লাস শুরু হবার মাধ্যমে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা চাই, শিক্ষার এই স্বাভাবিক পরিবেশ যাতে কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত না হয়। নোংরা ছাত্ররাজনীতি যাতে আর কোনো শিক্ষার্থীর জীবনকে ধ্বংস করতে না পারে।' সেশনজট যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন নাজমুল হক।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গ্রীষ্মকালীন ও ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হয় গত ২ জুন। এক মাস ছুটির পর ১ জুলাই থেকে ক্লাস খোলার কথা থাকলেও সর্বজনীন পেনশন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে, ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে নামেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের সঙ্গে কর্মবিরতি ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
ওইসময় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই। কোটা সংস্কারের দাবিতে ৭ জুলাই থেকে তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন। এই দুই ধাক্কায় তখন থেকেই প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে এবং তাতে যুক্ত হয় সংঘাত-সহিংসতা।
এরপর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর অন্তর্র্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
দায়িত্ব নিয়ে তিনি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দিলেও ক্লাসে ফিরছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
তাদের দাবি ছিল, আন্দোলনের সময় যেসব শিক্ষক নিপীড়নকারীদের পক্ষ নিয়েছিলেন, তাদের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত ক্লাসে ফিরবেন না। শিক্ষার্থীদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনসহ বিভিন্ন অনুষদে 'শুদ্ধি অভিযান' চালাচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মাকসুদুর রহমানসহ প্রক্টরিয়াল বডির সবাই পদত্যাগ করেন।
গত ১০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করলে নতুন উপাচার্য হন উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।
বেগম রোকেয়া হল, কবি সুফিয়া কামাল হল, শামসুন্নাহার হল, বিজয় একাত্তর হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও সলিমুলস্নাহ মুসলিম হলসহ বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষও পদত্যাগ করেন।
এরপর উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে অধ্যাপক নিয়াজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, বিভাগ, অফিস প্রধান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে ১৩ সেপ্টেম্বর এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় ক্লাস শুরুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।