তোফাজ্জলকে পেটানোর পর মুক্তিপণ চেয়েছিল ঘাতকরা
চিরনিদ্রায় শায়িত বাবা-মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে জড়িতদের বিচার দাবিতে স্থানীয়দের মানববন্ধন
প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নজমুল হক সেলিম, পাথরঘাটা (বরগুনা)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জলকে পেটানোর পর মুক্তির জন্য ঘাতকরা ২ লাখ টাকা চেয়েছিল বলে দাবি করেছেন তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে তোফাজ্জলের ভাবী শরিফার কাছে বুধবার রাতে এ মুক্তিপণ চাওয়া হয়।
এদিকে, তোফাজ্জলের মরদেহ জানাজা শেষে দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টায় বরগুনার পাথরঘাটার তালুকের চরদুয়ানীতে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা, মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি।
তোফাজ্জেলের ভাবী শরিফা বলেন, 'গতকাল রাতে (বুধবার) অপরিচিত একটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে আমার ফোনে কল আসে। কলটি ধরার পরই অপর প্রান্ত থেকে এক লোক তোফাজ্জল কী হয় তা জানতে চান। পরিচয় দিলে তিনি বলেন, 'সে চুরি করে ধরা পড়েছে, তাকে বাঁচাতে হলে ২ লাখ টাকা দিতে হবে।' এরপর তারা ফোনে ধমক দিতে থাকেন এবং বলেন কোনো মিথ্যা কথা বলবেন না, তাহলে সমস্যা হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পর বিভিন্ন লোকজন জানান তোফাজ্জল মারা গেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার স্বামীর বংশ-পরিচয় দেওয়ার মতো আর কিছুই রইল না। আমার দুই সন্তান বাবাহারা, তাদের একজন চাচা ছিল, তাও শেষ করে দিল। আলস্নাহর কাছে বিচার দিলাম, সরকারের কাছে দাবি যাতে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দেওয়া হয়।'
তোফাজ্জলের চাচা ফজলুর রহমান বলেন, 'তোফাজ্জলের বাবা আব্দুর রহমান প্রায় ১০ বছর আগে মারা যান। এর তিন বছর পর তার মা মারা যান। এর পর থেকেই মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েন এবং বড়ভাই নাসিরের আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন। ভাইও দুই বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েন তোফাজ্জল। এর কিছুদিন পর একটি প্রেমঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাজারের ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুর রহমান ও তার লোকজন তাকে মারধর করেন। এরপর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।'
তিনি বলেন, 'তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও কাউকে কিছুই করতেন না। শুধু পরিচিত লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে ২০ টাকা বা ৫০ টাকা টাকা চেয়ে নিতেন। আমি কখনোই তাকে চুরি করতে দেখিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে যে চুরির অপবাদ দেওয়া হয়েছে, এর কোনো সত্যতা পাইনি। আমরা অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।'
পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন বলেন, 'তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল, এটা আমি জানি। তার সঙ্গে যেটা হয়েছে এটা অমানবিক। যেসব নম্বর থেকে পরিবারের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে, সেসব নম্বর বর্তমানে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।'
চিরনিদ্রায় শায়িত বাবা-মা
ও ভাইয়ের কবরের পাশে
এদিকে, তোফাজ্জলের মরদেহ জানাজা শেষে দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টায় বরগুনার পাথরঘাটার তালুকের চরদুয়ানীতে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা, মা ও ভাইয়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি।
এর আগে সকাল ৯টায় চরদুয়ানী মাদ্রাসা মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর তোফাজ্জলের হত্যাকান্ডে জড়িতদের বিচার দাবিতে মানববন্ধন করেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৪ বছর আগে স্থানীয় এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমঘটিত কারণে বেদম মারধরের শিকার হন তোফাজ্জল। এ ঘটনার পর তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। পরে তার বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় এবং মা ও ভাই ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
স্বাভাবিক জীবনযাপনকালে কাঁঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সাবেক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তোফাজ্জল হোসেন। তিনি পাথরঘাটার তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে।
জানা যায়, বুধবার রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে তার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে ঢাবির ফজলুল হক মুসলিম হলে প্রবেশ করেন। ওই সময় চোর সন্দেহে তাকে আটক করে শিক্ষার্থীরা। পরে রাত ১০টার দিকে হলের গেস্টরুমে কয়েক দফা মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। তারপর আবার মারধর করা হয়। দীর্ঘসময় মারধরের ফলে তার অবস্থার অবনতি ঘটলে গুরুতর অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, তোফাজ্জল অত্যন্ত ভালো একটি ছেলে, তিনি দীর্ঘদিন মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় জীবনযাপন করছেন, তিনি কখনো চুরির কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না।
কিন্তু কেন তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থীরা বর্বরতা ও পাশবিক নির্যাতন করে জীবন্ত মানুষটাকে মেরে ফেলেছে। এরা শিক্ষা জাতির কলঙ্ক?। কলঙ্কিত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। আমরা পাথরঘাটাবাসীর পক্ষ থেকে তাকে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ড কামনা করছি।