ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) তোফাজ্জল নামে এক যুবক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এ ছাড়া দুই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে, ঢাবিতে হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলা ও তদন্ত কমিটি হয়েছে। ইতোমধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে নিন্দা জানানো হয়েছে। হত্যা বন্ধ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। বৃহস্পতিবার জুলাই বিপস্নবী ও সচেতন শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এবং নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এই বিক্ষোভ হয়।
অন্যদিকে, জাবিতে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দোষীদের বিচার চেয়ে বিক্ষোভ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ হত্যাকান্ডকে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের চক্রান্ত হিসেবে উলেস্নখ করে অবিলম্বে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা।
এছাড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রশিবিরও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন অনেকেই।
যেভাবে ঘটে দুই হত্যাকান্ড : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে 'গণপিটুনিতে' এক যুবককে হত্যা করা হয়েছে। হলের অতিথি কক্ষে বুধবার রাতে ৩২ বছর বয়সি তোফাজ্জল হোসেন নির্যাতনের শিকার হন।
ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. ফারুক বলেন, 'রাত ১২টার দিকে কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই যুবককে ঢাকা
মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন বলে দাবি করা হয়।'
তার কী হয়েছিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ কর্মকর্তা ফারুক বলেন, 'ফজলুল হক হলে তোফাজ্জলকে চোর সন্দেহে আটক করে মারধর করা হয়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম ছিল। তার মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে।'
নিহত তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নে। ঢাকা মেডিকেল মর্গে তার লাশ শনাক্ত করেন বন্ধু বেলাল গাজী।
বেলাল বলেন, 'বরিশাল বিএম কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করলেও মানসিক সমস্যার কারণে তোফাজ্জল কোনো কাজকর্ম করছিল না। গত ৩-৪ বছর ধরে তার এই মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ভবঘুরের মতো বেড়াত সে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেও থাকত অনেক সময়।'
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, বুধবার সন্ধ্যায় চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটকের পর তাকে গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করা হয়। পিটুনির পর ক্যান্টিনে নিয়ে খাবারও খাওয়ানো হয় তোফাজ্জলকে এবং সেই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর আবার চলে দীর্ঘ জেরা আর মারধর। পরে অবস্থার অবনতি হলে রাত ১২টার দিকে তোফাজ্জলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সরে যান। তোফাজ্জলের মৃতু্যর খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে এই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোলস্নাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বুধবার রাত ১০টার দিকে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃতু্য হয়। নিহত শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোলস্না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আশুলিয়া ইউনিয়নের কাঠগড়া এলাকার মোলস্নাবাড়ীর ইয়াজ উদ্দিন মোলস্নার ছেলে। বুধবার রাতে তাকে মারধরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ?্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
গত ১৫ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে আন্দোলনরতদের ওপর হামলার ঘটনায় শামীম সামনের সারিতে ছিলেন এমন অভিযোগ তুলে বুধবার বিকালে শিক্ষার্থীরা তাকে আটক করে। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকা থেকে ধরে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির কাছে তুলে দেয় শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে শামীমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখায় নেওয়া হয়। পরে প্রক্টরিয়াল বডি আশুলিয়া থানায় জানালে পুলিশ শামীম মোলস্নাকে আটক করে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার প্রধান কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, 'গণপিটুনির খবর পেয়ে নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে ৩৯ ব্যাচের এক সাবেক শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে আসে। পরে তাকে থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।'
আশুলিয়া থানার ওসি মো. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, 'খবর পেয়ে রাত পৌনে ৯টার দিকে মারধরের শিকার যুবককে উদ্ধার করে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃতু্য হয়েছে।'
গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, 'আমাদের এখানে আনার পর পরীক্ষা করে দেখি তিনি মৃত। তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে।'
বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ
মব জাস্টিসের নামে হত্যা বন্ধ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বৃহস্পতিবার সকালে ব্যানারসহ অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। জুলাই বিপস্নবী ও সচেতন শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই বিক্ষোভের ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এছাড়া নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারেও বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে, জাবিতে শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোলস্নার হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মহুয়া চত্বর থেকে মিছিল শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে এসে মিছিলটি শেষ হয়।
মিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন তারা। এ সময় বক্তারা এই হত্যাকান্ডকে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের চক্রান্ত হিসেবে উলেস্নখ করে অবিলম্বে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুর রশীদ জিতু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল প্রমুখ।
এর আগে জাবিতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হত্যার ঘটনাকে 'বিচারবহির্ভূত হত্যা' উলেস্নখ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী। বুধবার রাত ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে এ বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে যায়। সেখানে উপাচার্যের কাছে দোষীদের শাস্তির দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। এতে বক্তব্য রাখেন অর্থনীতি বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী।
তদন্ত কমিটি গঠন ও মামলা দায়ের
ঢাবিতে যুবক হত্যায় এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আলমগীর কবিরকে।
এছাড়া এ ঘটনায় বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় এজাহার দায়ের করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসার মোহাম্মদ আমানুলস্নাহ। পরে এজাহারটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম শাহাবুদ্দিন শাহীন গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অন্যদিকে, জাবিতে শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোলস্নাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছে জাবি কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় জাবি কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শামীম মোলস্নার মৃতু্যতে কর্তৃপক্ষের শোক প্রকাশ, তদন্ত কমিটি গঠন, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
তোফাজ্জল হত্যায়
আটক পাঁচজন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন হত্যার ঘটনায় মামলা করার পর পাঁচজনকে পুলিশে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বৃহস্পতিবার শাহবাগ থানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুলস্নাহ মামলাটি করেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনার মো. আব্দুলস্নাহ আল মামুন। তিনি বলেন, 'জড়িতদের গ্রেপ্তারে কাজ চলছে।'
তোফাজ্জলকে মারধর করার অভিযোগে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জালাল আহমেদ, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের মোহাম্মদ সুমন, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মোত্তাকিন সাকিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আল হোসেন সাজ্জাদ এবং গণিত বিভাগের আহসান উলস্নাহকে থানায় দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাদের হেফাজতে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাহবাগ থানার এসআই আল আমীন।
আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ
আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে এসব ঘটনা নিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়েছে। পোস্টে বলা হয়েছে, 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্র নামধারী কিছু বহিরাগত যারা সবাই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সামনে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে? আমরা এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানাই আর একই সঙ্গে ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িত সকলকে গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।
একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি হত্যাকান্ড ঘটেছে। একইভাবে পিটিয়ে একজনকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সকল হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিচার চাই। এভাবে দেশে অরাজকতা চলতে পারে না।'
প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রশিবির
এই দুটি হত্যার ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সাদেক আব্দুলস্নাহ স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের নেতৃবৃন্দ নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং ছাত্র-জনতাকে সকল প্রকার মব জাস্টিস বা মব কিলিং বন্ধ করতে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিষ্ক্রিয়তা পরিহার করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মব জাস্টিস বন্ধে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
জড়িতদের গ্রেপ্তারে সময়
বেঁধে দিল নাগরিক কমিটি
গণপিটুনিতে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় নাগরিক কমিটির পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়।
সংবাদপত্রের বরাত দিয়ে নাগরিক কমিটি বলেছে, হত্যাকান্ডের সময় দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নীরব ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপস্থিতিতেই পুরনো ফ্যাসিবাদী কায়দায় নির্যাতন করে প্রক্টরিয়াল বডির কাছে হস্তান্তর ও পরে থানায় পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। দুটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। গণ-অভু্যত্থানপরবর্তী সময়ে এ ধরনের হত্যাকান্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনের অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকার জবাবদিহি চায় নাগরিক কমিটি। তা না হলে অচিরেই গণ-অভু্যত্থানের শক্তি দেশের আপামর জনতার স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে রাজপথে সক্রিয় কর্মসূচি পালন করবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, 'জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও মব-ভায়োলেন্সের মতো সব ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ও উপাদানের শিগগিরই বিলোপ করতে হবে এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা করতে হবে। আমরা মনে করি, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং সকল অপরাধের বিচারের দায়িত্ব আদালতের। যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে তারা অপরাধ করছে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে বলে আমরা মনে করি।'
দুটি ঘটনাই বিচারবহির্ভূত
হত্যাকান্ড : এমএসএফ
জাবিতে শামীম আহমেদ এবং ঢাবিতে তোফাজ্জল হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। সংগঠনটি বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ প্রতিক্রিয়া জানায়। এমএসএফ বলেছে, এই দুই ঘটনা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের উদাহরণ।
বিবৃতিতে এমএসএফ জানায়, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এ ধরনের ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। এমএসএফ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ঘটনা দুটির বিষয়ে দ্রম্নততার সঙ্গে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছে।'
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের বিবৃতিতে বলা হয়, আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। গণপিটুনির ঘটনা সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। যারা নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করছেন তারা তৎক্ষণাৎ তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি কোনো আস্থা না রেখে এসব ঘটনা ঘটিয়ে চলেছেন।
এমএসএফ বলেছে, বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেকাংশে উন্নতি সাধিত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। এর ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট সোপর্দ না করে হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরে এক মতবিনিময় সভা শেষে তিনি এ মন্তব্য করেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, 'মব জাস্টিসের নামে আইন নিজের হাতের তুলে নেওয়া যাবে না। একজন অন্যায় করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করেন। আইন হাতে তুলে নেওয়ার কারও কিন্তু অধিকার নেই।'
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'এ ধরনের ঘটনাগুলো বিচারিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করবে। বিচারটাকে যদি বিশ্বাস না করেন, নিজেরাই 'মব জাস্টিস' করতে থাকেন তাহলে বিচার ব্যবস্থার আর দরকার কী?'
তিনি বলেন 'এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে মূল কারণ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। শুরুর দিকে কিছুটা সক্ষমতার ঘাটতিও ছিল, নৈতিক অবস্থানও দুর্বল ছিল। তারা যে গ্রেপ্তার করতে যাবে, নিজেরাই তো আন্দোলনের সময় অভিযুক্তের পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছিল। সুযোগটাও কম ছিল শুরুর দিকে। কিন্তু এখন পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটছে। এখন এই অজুহাত চলবে না।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, 'মব জাস্টিস কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। এখন যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তিনিও আরেকটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন। একটি মব আরও অনেকগুলো মব বয়ে নিয়ে আসে। 'সে আমার ক্ষতি করেছে, তাহলে নিজের বিচার নিজেই করব'- একটি সমাজে এ ধরনের প্রবণতা বেশি থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।'
তিনি বলেন, 'কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন, কিন্তু সে জায়গায় না গিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া মোটেও কাম্য নয়।'
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষ একত্র হয়ে ব্যক্তিগত ক্ষোভ-প্রতিহিংসার জায়গা থেকে অন্যের ওপর আক্রমণ করছে। এ ধরনের ঘটনা সেসব সমাজেই বেশি হয়ে থাকে যেসব সমাজ বিশ্বাসভিত্তিক বেশি এবং জ্ঞানভিত্তিক কম।'