চাকরিতে পুনর্বহাল চান গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি হারানো পুলিশ ক্যাডার কর্মকর্তারা। তবে তাদের যেহেতু কারোই এখন চাকরির বয়স নেই, তাই তারা যে যেখানে উপযুক্ত, সেই মর্যাদা ধরে যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারের যে জায়গাগুলোয় পুলিশ কন্ট্রিবিউট করতে পারে, সেখানে চুক্তিভিত্তিক পদায়ন করার দাবি জানান তারা।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সদ্যপতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে পুলিশ ক্যাডারের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের অনেককে শুধু অন্যায়ভাবে বরখাস্তই করা হয়নি, জেলও দেওয়া হয়েছে। অন্যায়ভাবে ওএসডি ও চাকরিচু্যত করা হয়েছে। অথচ তাদের কোনো অপরাধ ছিল না।
পুলিশের যে দুজন কর্মকর্তাকে জেল খাটানো হয়েছে, তারা নির্দোষ ছিলেন। তাদের দায়িত্ব পালনে কোনো গাফিলতি কিংবা ব্যর্থতা থাকতে পারে। তবে এজন্য জেল হতে পারে না। কিন্তু তাদের অন্যায়ভাবে পাঁচ বছর করে জেল খাটানো হয়েছে। এতে যে তারা শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাই-ই নয়, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তাদের মর্যাদা ভূলণ্ঠিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত সব পুলিশ কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে তারা তাদের হারানো সম্মান কিছুটা হলেও ফিরে পাবেন। একই
সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের যে অন্যায়ভাবে ওএসডি, চাকরিচু্যত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল তা প্রমাণিত হবে বলে মনে করেন তারা।
আওয়ামী লীগ আমলে চাকরি হারানো পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা জানান, ২০০৯ সালে তাদের ২৪ কর্মকর্তাকে একসঙ্গে বরখাস্ত করা হয়েছে। আরও ২৬ জনকে বিভিন্নভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের ট্রেনিং সেন্টারসহ বিভিন্ন অগুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং দিয়ে বছরের পর বছর সেখানে ফেলে রাখা হয়েছে। তাদের কাজে না লাগিয়ে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক একে মাহফুজুল হক বলেন, তিনি পুলিশ ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টরের পদ থেকে ২০০৯ সালে তাকে ওএসডি করা হয়। পরে ২০১৩ সালের ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে অবসর দেওয়া হয়।
সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তার মতো অর্ধশত পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাকে অন্যায়ভাবে ওএসডি ও চাকরিচু্যত করা হয়েছে। তারা সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা তাদের কাছে দুটি দাবি জানিয়েছে। প্রথমটি হলো, যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচু্যত করা হয়েছে, প্রত্যেককে তাদের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। দ্বিতীয় দাবিটি হলো- তাদের মধ্যে যারা যেখানে উপযুক্ত তাকে সেখানে চুক্তিভিত্তিক পদায়ন করতে হবে।
মাহফুজুল হক আরও বলেন, পুলিশ ক্যাডারকে ব্যবহার করে স্বৈরাচার সরকার এই সমন্বয়ক দলকানা, পক্ষপাতদুষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র হত্যাকারী কর্মকর্তাদের দিয়ে পুলিশ পরিচালনা করেছে। যে কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার জন্য দায়ী, যারা পরিকল্পনাকারী, যারা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল, তাদের চাকরিচু্যত করতে হবে। তাদের চাকরিচু্যত করে সেসব শূন্য পদে চুক্তিভিত্তিক পুলিশ সদর দপ্তরে চাকরিচু্যতদের পদায়ন করতে হবে।
প্রসঙ্গত, মাহফুজুল হককে ২০১৩ সালের ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে অবসর দেওয়া হয়। তাকে ২০০৯ সালের ১৫ মার্চ থেকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হয়েছিল। আর অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মাজেদুল হককে অবসর দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ১২ জুন। তিনি ২০০৯ সালের ১৫ মে থেকে ওএসডি অবস্থায় ছিলেন। এই দুই কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় গণকর্মচারী (অবসর) আইন, ১৯৭৪ অনুসারে তাদের অবসর দেওয়া হয়েছে বলে ওই সময় পুলিশ সদরদপ্তর থেকে জানানো হয়।
যদিও সেখানকার একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, এই দুই কর্মকর্তা বিএনপির আমলে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মরত ছিলেন। এ কারণে তাদের বিএনপির ঘনিষ্ঠ বলে ধরে নেওয়া হয়। আর এ কারণেই তাদের প্রতি এই অবিচার করা হয়েছে।
এর আগে ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ও ফারুক আহমেদ, পুলিশ সুপার কোহিনূর মিয়া ও সহকারী পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিনকে বিভিন্ন অভিযোগে চাকরিচু্যত করা হয়। এ ছাড়া সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) খোদা বখস চৌধুরী, অতিরিক্ত আইজিপি বজলুর রহমান, মিজানুর রহমান ও ডিআইজি আনিসুর রহমান ওএসডি থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক অবসরে যান। উলেস্নখ্য, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিন দফায় পুলিশের ৬২ জন সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি হারানো পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক পদায়নের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান যায়যায়দিনকে বলেন, রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যেহেতু পদায়ন করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইচ্ছে-অনিচ্ছার ওপর। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু মাত্র দেড় মাস আগে ক্ষমতায় এসেছে; তাই আমরা সময় নিচ্ছি।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অবসরে পাঠানো পাঁচ অতিরিক্ত সচিবকে বিভিন্ন দপ্তরের সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গত ১৭ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন অতিরিক্ত সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ, অতিরিক্ত সচিব মো. এহছানুল হক, অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন, অতিরিক্ত সচিব ড. নাসিমুল গণি ও অতিরিক্ত সচিব এমএ আকমল হোসেন আজাদ। তারা সবাই বিসিএস ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা।
তাদের মধ্যে ড. শেখ আব্দুর রশিদ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে, মো. এহছানুল হককে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ, ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেনকে জননিরাপত্তা বিভাগে, ড. নাসিমুল গণিকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগে এবং এমএ আকমল হোসেন আজাদকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, 'সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৯ অনুযায়ী পাঁচ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অন্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে তাদের নামের পাশে উলিস্নখিত পদ, মেয়াদ ও মন্ত্রণালয়/বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হলো।'
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, 'চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাবিত মেয়াদ যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছর। এই নিয়োগের অন্য শর্ত অনুমোদিত চুক্তিপত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে।
অবসরপ্রাপ্ত ওই পাঁচ অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের এক দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৮ আগস্ট তাদের সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা দেওয়া হয়।
এর আগে গত ১৪ আগস্ট বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ১৯ সচিবের মধ্যে ১০ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দপ্তর বদল করা হয়েছে তিন সিনিয়র সচিবের। পৃথক আদেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নবনিয়োগ থেকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) বিভিন্ন ক্যাডারে ২৮ থেকে ৪২তম ব্যাচে সুপারিশপ্রাপ্ত ২৫৯ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন কোনো কারণ ছাড়াই তাদের নিয়োগ স্থগিত রাখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।