মাঠ প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ
কারো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং কাউকে ওএসডি করায় এখন ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ খালি আছে। এসব মন্ত্রণালয়ের কাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে
প্রকাশ | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর সাড়ে ১৫ বছর বঞ্চনার শিকার বিপুল সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তার পদোন্নতি ও পদায়ন হলেও মাঠ প্রশাসনে বিতর্ক আর অস্থিরতা থামছেই না। এর কারণ বিভিন্ন স্থানে পতিত সরকারের সুবিধাভোগীদের অনেকে এখনো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে রয়ে গেছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনে কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। তাই বর্তমানে মাঠ প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, কারো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং কাউকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করায় এখন ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ খালি আছে। এসব মন্ত্রণালয়ের কাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
শুধু প্রশাসন ক্যাডার নয়। এর বাইরে পেট্রোবাংলা, এলজিইডি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়সহ সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও প্রশাসনে কাজের গতি ফেরেনি। এতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ডিসি নিয়োগ ইসু্যতে নিজেদের দাবি আদায়ে সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বিক্ষোভের মুখে নবনিযুক্ত ডিসিদের মধ্যে ৮ জনের নিয়োগ বাতিল ঘোষণা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অবসরে যাওয়া ৫ জন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ নিয়েও জনপ্রশাসনে অসন্তোষ আছে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর দেশের ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে উপসচিব পর্যায়ের একদল বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা হট্টগোল করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কেএম আলী আযমের কক্ষে হট্টগোল করেন বিক্ষুব্ধ উপসচিবরা। এ সময় কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। ডিসি পোস্টিংয়ের জন্য গঠিত এসএসবি বোর্ডের সদস্য সচিব আলী
আজমকে লাঞ্ছিত করেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা। এ নিয়ে তদন্ত কমিটিও হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে জোট বেঁধেছেন বিসিএস ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়নে ২৪, ২৫ ও ২৭তম বিসিএস ব্যাচের কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ওঠেছে। তাদের সবারই যুগ্ম সচিব হওয়ার সময় প্রায় চলে এসেছে। ফলে তারা যদি বর্তমানে ডিসি হিসেবে নিয়োগ না পান, তাহলে আবারো বঞ্চিত হবেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত প্রশাসনের ওপর এত চাপ তৈরি হয়নি। অভিযোগ রয়েছে গত ১৫ বছর দলীয়করণ, মেধা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পদোন্নতির কারণেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞ সিএস শফি সামি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতন-পরবর্তী সময় থেকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণেরও দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। বিচার-বিবেচনার জন্য দেড় মাস স্বল্প সময় হলেও জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের বিষয়ে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। সরকারের উচিত সময় নিয়ে পর্যালোচনার মাধ্যমে যোগ্য কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। যেন নিয়োগের এক দিনের ব্যবধানে তা বাতিল কিংবা কাউকে বদলি করতে না হয়। গত ১৫ বছরে যেভাবে জনপ্রশাসন দলীয়করণ হয়েছে তা রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনে সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে নিয়োজিতদের প্রায় ৯৫ শতাংশই ছিল অ্যাডমিন বা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারেও এখন পর্যন্ত যারা সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদেরও সবাই অ্যাডমিন ক্যাডারের। উপরন্তু বর্তমান সরকারের সিনিয়র সচিব ও সচিবদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি নিয়োগ হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। আবার তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত অপরাধগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে সরকারকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও দায়ী করা হয় তাদের। বিতর্কিত নির্বাচন থেকে শুরু করে যেসব কর্মকান্ড গত সরকারকে স্বৈরতান্ত্রিক রূপ দিয়েছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রেও প্রশাসক ক্যাডাররাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
সাবেক সচিব আনোয়ার কবির বলেন, প্রশাসনকে বলা হয় 'রাষ্ট্রের হৃৎপিন্ড'। মাঠ প্রশাসনের প্রথম ধাপ হচ্ছে বিভাগীয় প্রশাসন। দ্বিতীয় ধাপে হচ্ছে জেলা প্রশাসন। তৃতীয় ধাপ হচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। এই উপজেলা প্রশাসন তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত। মাঠ প্রশাসনে জেলা পর্যায়ে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব ডিসির। অথচ একজন ডিসির রাজনৈতিক, সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয়। যখন তার আচরণ হয়ে ওঠে মারমুখী এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ, তখন প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
অন্তর্বর্তী সরকার এ পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১৯৮টি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনপ্রশাসনে ১৩৫ জনকে অতিরিক্ত সচিব, ২২৭ জনকে যুগ্মসচিব ও ১২০ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে। ৬৭ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ওএসডি করা হয়েছে ১০ জন যুগ্মসচিব, আটজন অতিরিক্ত সচিব ও ছয়জন সচিবকে। অভিযোগ ওঠে এদের মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত কর্মকর্তা। তাদের কেউ কেউ অতীতে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভাগীয় মামলা শাস্তি পেয়েছিলেন। কেউ কেউ ছিলেন পতন হওয়া আওয়ামী লীগের নানা অপকর্মের সহযোগী। এখন তারাই 'বঞ্চিত' সেজে সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ।
পুলিশের ৮০ জন ডিআইজি, ৩০ জন পুলিশ সুপারসহ ১১০ জনকে পদোন্নতি, একজন ডিআইজি, একজন অতিরিক্ত ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপারকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। এছাড়া আইজিপিসহ ১০ জন অতিরিক্ত আইজি, ৮৮ জন ডিআইজি, ২১ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, ১৭৭ জন পুলিশ সুপারসহ মোট ২৯৭ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।
এরমধ্যে ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পর ফেনীর সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এনামুল করিমের নিয়োগ নিয়ে সমালোচনা চলছে। খুলনার ডিসি মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করছেন তার সহকর্মীরা। হবিগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা হাইকমিশনের উপহাইকমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নবনিযুক্ত এ ডিসির অপসারণ চেয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে খুলনার সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ। মাগুরার ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মো. অহিদুল ইসলাম ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে ৫ বছর মরিশাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নোয়াখালীর ডিসি খন্দকার ইসতিয়াক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। কুমিলস্নার জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তা আমিরুল কায়সার। তার বিরুদ্ধে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে ডিসি হওয়ার অভিযোগ তুলেন তার সিনিয়র সহকর্মীরা।