ভারতের সুর বদল!
প্রকাশ | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
ছাত্র-জনতার প্রবল গণঅভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের প্রায় দেড় মাস পর ভারত তার সুর বদল করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর দিলিস্ন ও ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের সুর নরম হয়েছে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
উলেস্নখ্য, ডোনাল্ড লুর ১৪ সেপ্টেম্বর বিকালে ঢাকায় আসার আগে দিলিস্ন সফর করেন। সেখানে তিনি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পররাষ্ট্রসচিব বিজয় মোহন কোয়াত্রার সঙ্গে কথা বলেন।
এ ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, এটি অসম্ভব নয়। তবে নিশ্চিত নন। এই বিষয়টি তখনই সমর্থিত হবে যখন প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যে বৈঠকের কথা বলেছেন সেটা হলে বোঝা যাবে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে।
একই বিষয়ে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওয়াবেদ বলেন, বৈঠকে কি কথা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তবে বিশ্লেষণ হচ্ছে, এটি অস্বাভাবিক নয়। ভারতের বিষয়ে এদেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট হচ্ছে এক ধরনের। তা পরিবর্তনে দেশটিকে এমন কিছু দেখাতে হবে যে, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো হবে সমতার ভিত্তিতে। সম্পর্ক হবে দেশের সঙ্গে, কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে নয়।
এরপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সে দেশের 'অভ্যন্তরীণ বিষয়'। তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন নয়। কিন্তু প্রতিবেশী
\হহিসেবে সে দেশের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক জারি রাখতে ভারত আগ্রহী। সম্পর্ককে ভারত আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
জয়শঙ্কর বলেন, 'প্রতিবেশীরা একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এই সম্পর্ক ও যোগাযোগ আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা আগ্রহী।'
নরেন্দ্র মোদি সরকারের তৃতীয় দফার শাসনের ১০০ দিন অতিক্রান্ত উপলক্ষে জয়শঙ্কর একথা বলেন এনডিটিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে। সেখানেই পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলার সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই মন্তব্য করেন। বস্তুত এই প্রথম বাংলাদেশের পালাবদল ও সে দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে সরকারের পক্ষে এত বিস্তারিত কেউ মতামত জানালেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল ও সেই পরিস্থিতিতে ভারতের ইতিকর্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়শঙ্কর বলেন, 'সব সময় সবকিছু ঠিক থাকবে তা হয় না। সব সময় সবকিছু অনুকূলও থাকে না। বাংলাদেশে যা হয়েছে তা তাদের নিজস্ব রাজনীতি। একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাজেই সে বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা অনভিপ্রেত। এটুকু বলতে পারি, আমরা সব সময় বিদ্যমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলি।'
জয়শঙ্কর এ প্রসঙ্গে বলেন, 'আমার বিশ্বাস, ওরা ওদের অবস্থান বুঝে নিলে এবং সম্পর্কের মাহাত্ম্য অনুধাবন করলে প্রতিবেশী সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে। প্রতিবেশীরা সব সময় একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল হয়।'
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করে জয়শঙ্কর অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কেরও উলেস্নখ করেন। তিনি বলেন, 'অন্য প্রতিবেশী দেশেও কোথাও কোথাও রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মিটমাট হয়ে গেছে। বাংলাদেশেও যা হওয়ার তা হবে। সে নিয়ে মন্তব্য করা সাজে না। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে, আমরা তা আমাদের দিক থেকে স্থিতিশীল রাখতে চাই। সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।' তিনি বলেন, 'আমাদের মধ্যে খুব ভালো সহযোগিতা আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগও চমৎকার। আমরা এ পথেই এগোতে চাই।'
এর আগে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে জুলাই মাসে আন্দোলনে নামেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশি বাধার মুখে একসময় শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে রূপ নেয়। এই অভু্যত্থানে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হন হাসিনা। তিনি বর্তমানে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। ভারত থেকে হাসিনা যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন কিন্তু তাকে ভিসা দেয়া হয়নি। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী হাসিনা এখন ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর নিরাপত্তায় রয়েছেন।
গত মাসে জয়শঙ্কর ভারতীয় পার্লামেন্ট লোকসভায় বলেছিলেন, হাসিনা খুব অল্প সময়ের নোটিশে দিলিস্নর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। তারপর একটি সর্বদলীয় ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, হাসিনাকে তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ভারত সরকার সময় দেবে। হাসিনা পালানোর পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার শপথের পরই তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফোনকলের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানান। পরে ড. ইউনূস বলেছেন যে, ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক করতে আগ্রহী বাংলাদেশ। ৮৪ বছর বয়সি ড. ইউনূস বলেন, 'আমরা চাই বিশ্ব বাংলাদেশকে একটি সম্মানিত গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।' ভারতকে উদ্দেশ্য করে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সামনের দিনে ভারতকে একটি ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেটি হলো বাংলাদেশের সবাই ইসলামপন্থি, বিএনপি ইসলামপন্থি। বাকি সবাইও ইসলামপন্থি এবং (তারা) এই দেশটিকে আফগানিস্তানে পরিণত করবে। আর বাংলাদেশ শেখ হাসিনার হাতেই নিরাপদ। এসব ধারণা থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশও অন্য প্রতিবেশীর মতো একটি প্রতিবেশী দেশ।