ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ কাটিয়ে পোশাক কারখানাগুলো উৎপাদনে ফিরতে না ফিরতেই ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে শিল্পাঞ্চল। মঙ্গলবার ত্রিমুখী সংঘর্ষের মধ্যে এক নারী শ্রমিক নিহতের ঘটনায় ওই অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০ শ্রমিক।
এদিকে, গাজীপুর ও টঙ্গীতে বকেয়া বেতন চেয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা। এ সময় উভয় সড়কেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে পথচারী ও গণপরিবহণে থাকা সাধারণ যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। এ ছাড়া, বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মঙ্গলবার আশুলিয়ায় ১৯টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। এর মধ্যে ১৫টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নির্মল কুমার দাস সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে জিরাবো এলাকায় তিনটি কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে মোছা. রোকেয়া বেগম (৩০) নামে এক শ্রমিক নিহত হন। রোকেয়া ওই এলাকার ম্যাসকট গার্মেন্ট লিমিটেডের কারখানায় সহকারী সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি কারখানাটিতে যোগ দিয়েছিলেন।
শিল্প পুলিশের সূত্রে জানা যায়, ম্যাসকট গার্মেন্ট লিমিটেড কারখানাটি শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ ছিল। মঙ্গলবার সকালে শ্রমিকরা বন্ধ কারখানার ফটকে অবস্থান নিয়ে কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন।
এ সময় কয়েকজন শ্রমিক পাশের সাউদার্ন ও রেডিয়েন্স গার্মেন্টে হামলা করেন। এরপরই ওই দুই কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে ম্যাসকটের
\হশ্রমিকদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়।
পরিদর্শক নির্মল কুমার দাস বলেন, 'ম?্যাসকট গার্মেন্টের শ্রমিকদের সঙ্গে অন্য কারখানার শ্রমিকদের সংঘর্ষে ইটপাটকেল লেগে নারী শ্রমিক মারা যান। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।'
গাজীপুর ও টঙ্গীতে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, বিভিন্ন দাবিতে কয়েকটি কারখানায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। মঙ্গলবার জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা, চক্রবর্তী, গাজীপুর সদরের শিরিরচালা এলাকার কারখানার শ্রমিকরা এই বিক্ষোভ করেন। এতে কাশিমপুরের বেক্সিমকো থেকে জিরানি পর্যন্ত যানজট লেগে যায়।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা ও চক্রবর্তী এলাকায় চন্দ্রার মাহমুদ জিন্স লিমিটেড, নায়াগ্রা টেক্সটাইল লিমিটেড এবং সারাবো এলাকার বেক্সিমকো টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। গাজীপুর সদর উপজেলার জয়দেবপুর থানার মেম্বারবাড়ি (শিরিরচালা) এলাকার এক্সিকিউটিভ হাই ফ্যাশন লিমিটেডের শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করছেন।
এক্সিকিউটিভ হাই ফ্যাশন লিমিটেডের আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, এই কারখানায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সোমবার কারখানা ছুটির পর রাত ১০টায় আয়রনম্যান আরমান বাসায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা তাকে মারধর করে মানিব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। পূর্বে শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করেন। শ্রমিকদের সন্দেহ, দাবি উপস্থাপন করায় কারখানা কর্তৃপক্ষের লোকজন পরিকল্পিতভাবে তাদের লোকজন দিয়ে আরমানকে মারধর করে থাকতে পারে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে মারধরের প্রতিবাদে তারা শান্তিপূর্ণ কর্মবিরতি পালন করেন। ওই দুই কারখানার শ্রমিকরা কালিয়াকৈর-নবীনগর ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় প্রায় এক ঘণ্টা ওই সড়ক দুটিতে যান চলাচল ব্যাহত হয়। যান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় তীব্র গরমের মধ্যে চালক ও যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দিলে শ্রমিকদের দাবির বিষয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছে।
সকাল থেকেই গত মাসের বকেয়া বেতনের দবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা এলাকায় একপাশ অবরোধ করে বিক্ষোভ করে নায়াগ্রা টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিকরা। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
গাজীপুর সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুরের তাসমিয়া হারবাল লিমিটেডের শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধিসহ আট দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করেছেন। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে তারা কর্মবিরতি পালন করে কারখানার অভ্যন্তরে হট্টগোল শুরু করেন। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেন। ৯ দফা দাবিতে বেতন বৃদ্ধিসহ আন্দোলন করছেন ভেরিতাস ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের শ্রমিকরা।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের বেক্সিমকো জোনের সহকারী পুলিশ সুপার গোলাম মোর্শেদ জানান, শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়কের ওই দুই স্থানে অবরোধ করলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এনে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শিল্পপুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
এদিকে, টঙ্গীর পশ্চিম থানার খাঁ-পাড়া এলাকার সিজন ড্রেস কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে নেয় এবং বেতন-ভাতা পরিশোধে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
টঙ্গী পশ্চিম থানার পরিদশর্ক (তদন্ত) জাকির হোসেন বলেন, কারখানার মালিকপক্ষ প্রায়ই বেতন নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে ঝামেলা করে। এর আগেও শ্রমিকরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানালে কয়েকবার শ্রমিকরা আন্দোলন করে তাদের দাবি পূরণ করেছে। সকাল থেকে দুই মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা মহাসড়কে নামেন।
কারখানার মালিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী বাকের বলেন, তাদের দুই মাসের এবং ১৫ সেপ্টেম্বর জুলাই মাসের অর্ধেক বেতন দেব বলেছিলাম। শ্রমিকরাও সেটা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাংকের টাকা উত্তোলন-সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে এখনো টাকা দিতে পারিনি। আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনেই বিক্ষোভ শুরু করেছেন। শ্রমিকদের একটি পক্ষ উসকে দিয়ে বিক্ষোভ করাচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।