বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রাজধানীতেও। গত দুদিন ধরে চলা টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তিলোত্তমা এ নগরীর জনজীবন। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন শ্রমজীবীরা।
নিম্নচাপের প্রভাবে গত শুক্রবার রাত থেকেই রাজধানীতে ঝরছে বৃষ্টি। কখনো ঝিরিঝিরি তো কখনো মুষলধারে নামছে বারিধারা। সঙ্গে বইছে ঝড়ো হাওয়া, যা রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
এদিকে, গত দুদিনের এ বৃষ্টিতে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তীব্র তাপপ্রবাহের পর বৃষ্টি জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এলেও একইসঙ্গে ভোগান্তিতে ফেলে চাকরিজীবী ও শ্রমজীবীদের। টানা বৃষ্টির কারণে অনেকে ঘর থেকে বের না হলেও শ্রমজীবীদের পেটের দায়ে রাস্তায় বের হতে হয়েছে। সামর্থ্যবানরা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছাতা বা রেইনকোট ব্যবহার করলেও শ্রমজীবীদের বৃষ্টিতে ভিজেই তাদের কাজ করতে দেখা গেছে। তবুও হয়নি চাহিদামতো আয়।
রোববার সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে তুলনামূলক সড়কে মানুষের চলাচল ছিল অনেক কম। জরুরি প্রয়োজন ও কর্মজীবীরা ছাড়া সাধারণ মানুষ ঘর থেকে তেমন বের হয়নি। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও কম দেখা গেছে। ফলে রিকশাচালক, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের যাত্রী ও ক্রেতা সংকটে পড়তে হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় কাঁপলেও উঠেনি পেট চালানোর অর্থ। যারা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চা-সিগারেট বা বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন, তাদের থমকে থাকতে হয়েছে কোনো ছাদের নিচে। শ্রমজীবীদের পাশাপাশি কর্মজীবীদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় গণপরিবহণ কম চলাচল করায় কর্মস্থলে যেতে দীর্ঘ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে তাদের। যাত্রী সংকটে ভুগতে হয়েছে রাইড শেয়ারিং করা মোটরসাইকেল চালকদেরও।
তেমনি একজন সজীব আহমেদ। ধানমন্ডি-২৭ নম্বরে রাফা পস্নাজার সামনে মোটরসাইকেল রেখে মার্কেটের সিঁড়িতে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে। তিনি বলেন, কয়দিন রোদ-গরমের কারণে যাত্রী পাইনি। এখন বৃষ্টির কারণে যাত্রী নেই। কেউই বৃষ্টিতে মোটরসাইকেলে যাচ্ছে না। বৃষ্টিতে ভিজে সকালে বের হয়েও এখনো কোনো যাত্রী পাইনি। রাইড শেয়ারিং করা ছাড়া আর কোনো আয়ের উৎস নেই আমার। তাই বাধ্য হয়েই বের হতে হয়েছে। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। আয়-রোজগার পুরোই বন্ধ।
বৃষ্টিতে স্বস্তি প্রকাশ করলেও যাত্রী না পাওয়ার অনুযোগ করেছেন রিকশাচালক মো. হায়দার। সোবহানবাগ মসজিদের
সামনে কথা হলে তিনি বলেন, মাঝে কয়দিন গরমে খুব কষ্ট হইছে। এখন বৃষ্টিতে লাগছে ঠান্ডা। তাও গরমের থেকে বৃষ্টি ভালো। কিন্তু বৃষ্টিতে তেমন যাত্রী নেই। তাও কোনো অভিযোগ নেই। আলস্নাহ যা করেন, ভালোর জন্য করেন।
একই এলাকায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে বেসরকারি চাকরিজীবী দেবদাস বিশ্বাসকে। তিনি বলেন, রাস্তায় যানবাহন কম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও নির্দিষ্ট গন্তব্যের বাস পাচ্ছি না। অন্য সময় হলে বাইকে চলে যেতাম। বৃষ্টির কারণে সেটি করতে পারছি না। আবার অফিস যেতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে গরম কমালেও ভোগান্তি বাড়িয়েছে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে যশোর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। এতে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে। পাশাপাশি সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে।
৭৮ ঘণ্টায় ঝরেছে ৩৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি
এদিকে শরতের অবিরাম বর্ষণে বরিশালের জনজীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া টানা বর্ষণ আর ঝড়ো আবহাওয়ায় থমকে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। নগরের প্রায় সব রাস্তাঘাটে হাঁটুসমান পানি জমে আছে। শহরের বিভিন্ন এলাকার বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ।
আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বরিশালে গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৭৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি ঝরেছে ৩৪৪ মিলিমিটার। অথচ আবহাওয়া বিভাগের বৃষ্টিপাতের গড়পঞ্জি হিসাবে পুরো সেপ্টেম্বরে এখানে বৃষ্টি ঝরার কথা ২৫৯ মিলিমিটার। অর্থাৎ পুরো মাসের বৃষ্টির স্বাভাবিক হিসাব ছাপিয়ে মাত্র ৭৮ ঘণ্টায় ৮৬ মিলিমিটার অতিরিক্ত বৃষ্টি ঝরেছে। এই অতিবৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে নদ-নদীতে উঁচু জোয়ার। এতে বৃষ্টির পানি নদীতে নিষ্কাশিত হতে পারছে না। তেমনি নদীর উঁচু জোয়ারের পানিও নর্দমা দিয়ে এসে পড়ছে নগরে। এতে বরিশাল নগরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
রোববার নগরের নবগ্রাম রোড, আমির কুটির, অক্সফোর্ড মিশন রোড, কলেজ অ্যাভিনিউ, গোরস্থান রোড, সার্কুলার রোড, ভাটিখানাসহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা দেখা যায়, সেগুলো জলাবদ্ধ। অক্সফোর্ড মিশন এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দা পানিবন্দি। নিচু ও কাঁচা ঘরে রান্না পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।
নগরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই সদর সড়ক, গোরস্থান রোড, কালু শাহ সড়ক, বটতলা, বাংলাবাজার, কলেজ অ্যাভিনিউ, ফকিরবাড়ি সড়ক, আমির কুটির, অক্সফোর্ড মিশন রোড, গোরস্থান রোড, ভাটিখানা, আমানতগঞ্জ, মলিস্নকবাড়ি সড়ক, ব্রাউন কম্পাউন্ড, মহিলা কলেজ ও এর আশপাশ এবং নগরের পূর্বাংশের বিশাল এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তখন ঘর থেকে বের হওয়াই মুশকিল হয়ে যায়। এ ছাড়া রাস্তায় গাড়িও তেমন চলাচল করে না। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে চলাচলে খুবই সমস্যা হয়।
মৌসুমি বৃষ্টিপাত ছিল তলানিতে
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, চলতি বছর বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলে বৃষ্টির পরিমাণ একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে মাত্র ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ফেব্রম্নয়ারিতে ২৭ মিলিমিটার হওয়ার কথা থাকলে বৃষ্টি ঝরেছে ২১ মিলিমিটার। আর মার্চে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৫৭ মিলিমিটার, হয়েছে ২৫ মিলিমিটার। সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে এপ্রিল মাসে। ওই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ১৩২ মিলিমিটার। কিন্তু বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৯ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৬ শতাংশ কম।
অন্যদিকে মে মাসে বরিশাল বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল ২৩২ দশমিক ৯ মিলিমিটার। কিন্তু হয়েছে বেশি, ৩৯৪ দশমিক ৫০ মিলিমিটার। এর মধ্যে মে মাসের শেষ দিকে ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ২৪ ঘণ্টায় ১৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
এর অর্থ, বর্ষা মৌসুমে এবার স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়নি। হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এই প্রবণতা বেশ কয়েক বছর ধরেই অব্যাহত আছে। এতে এবার এ অঞ্চলে ধারাবাহিক অস্বাভাবিক তাপমাত্রা মানুষকে বেশ ভুগিয়েছে।