বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, '১৬ বছরে গণতন্ত্রের সংগ্রামে আমরা নিপীড়িত হয়েছি। প্রায় ৭০০ ভাইবোন গুম হয়েছে। এখনো গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছেলেমেয়েরা কেঁদে বেড়াচ্ছেন। ছোট্ট শিশুরা তার বাবা মাকে খুঁজছে। সেই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে ষাট লাখ মানুষের নামে মামলা হয়েছে। এগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের যেন কেউ বিভাজিত করতে না পারে।'
শনিবার বিকালে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাজনৈতিক দমন পীড়নের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে ও আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজ এবং হত্যা-খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারের স্বজনরা।
এ সময় জুলাই আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময় নিহত, আহত এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের আলোকচিত্র তুলে ধরেন স্বজনরা। ভুক্তভোগী কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। অনেকে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনুষ্ঠানের বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে গান পরিবেশন করা হয়, জুলাই অভু্যত্থান নিয়ে মূকাভিনয় প্রদর্শন করা হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, '২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। যারা প্রতিনিয়ত গুম খুনের আশ্রয় নিয়েছিল। ১৬ বছরে অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে। আজকে আমরা সবাই স্বাধীন হয়েছি হয়ত, এখনো চতুর্দিকে চক্রান্ত চলছে।'
তিনি বলেন, 'আজকে একটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার পেয়েছি। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের আশা আকাশচুম্বী। জনগণ প্রত্যাশা করে, তারা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড তৈরি করবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে আগের জায়গায় আনবে, যেখানে সত্যিকার অর্থে একটি অর্থবহ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।'
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অনুরোধ করব, যারা পঙ্গু
হয়েছেন, যারা ১৬ বছর ধরে শহীদ হয়েছেন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের ভাতা দিতে হবে। এটা অত্যন্ত জরুরি ব্যাপার। শুধু অনুষ্ঠান করলেই হবে না, সরকারের কাছে জোরাল দাবি তুলে ধরতে হবে।
গোপালগঞ্জে বিএনপি নেতা শহীদ হয়েছেন জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, তারা হায়েনার মতো লুকিয়ে আছে। যে কোনো সময় আক্রমণ করতে পারে। আমাদের সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
গত ১৮ জুলাই সাভারে পুলিশের নির্বিচার গুলির পর সাঁজোয়া যানের ওপর মুমূর্ষু মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) ছাত্র আসহাবুল ইয়ামিনকে ঘুরানো হয়, পরে জীবিত অবস্থায়ই সড়ক বিভাজনে ফেলে দেওয়া হলে সেখানেই মৃতু্যবরণ করেন ইয়ামিন।
ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দীন বলেন, 'বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ, এর থেকে ভারী কোনো বোঝা নেই। আর কোনো বাবা-মা, বোনকে এই নির্মম পরিস্থিতির মুখোমুখি যেন না হতে হয়। কাউকে সাঁজোয়া যান থেকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য আর যেন দেখতে না হয়। কোনো ইয়ামিনকে যেন পুলিশের ঘৃণার পাত্র হতে না হয়। আগামী দিনে পুলিশ যেন তার সঠিক দায়িত্ব পালন করে। আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই এবং শহীদের মর্যাদা দেওয়ার আহ্বান জানাই।'
টাঙ্গাইলে দুই চোখ হারানো হিমেল আহমেদের মা নাসিমা আক্তার বলেন, '৪ আগস্টের সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল হিমেল। ছিল টাঙ্গাইল শহরের মূল সড়কে একটি মিছিলের নেতৃত্বে। তারা স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সামনে পৌঁছলে গুলি ছুড়তে শুরু করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই সময় মিছিলের সামনে থাকা হিমেলের মাথা ও মুখমন্ডলে শতাধিক ছররা গুলি লাগে। আমাদের পাশে আপনারা দাঁড়াবেন।'
নিহত রিটন চন্দ্র শীলের মা রুবী রাণী শীল বলেন, 'আমার ছেলে ছাত্রদল করত। সে গেছিল তারেক জিয়ার মিছিলে। তারে নিয়া নৃশংসভাবে মারছে। আমি তার উপযুক্ত বিচার আপনাদের কাছে চাই। আমার ছোট ছেলেও গুলি খেয়ে চিকিৎসাধীন। আমার সংসারে আর কেউ নাই। খুনি হাসিনার বিচার আমরা চাই।'
টাঙ্গাইল কলেজের ছাত্র ইমন গত ৫ আগস্ট শহীদ হয়েছিল। তার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাত। ইমনের ভাই সুমন বলেন, 'আমরা তিন ভাই। আমার বড় ভাই যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে তখন বাবা মারা যায়। এরপর ইমন ভাই ছিল পরিবারের সব। তিনি নিজে পড়তেন এবং আমাদের পড়াতেন। তিনি গুলি লেগে আহত হয়ে ১৮ আগস্ট হাসপাতালে মারা যান। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে, আমি তার বিচার চাই। আমার ভাইয়ের বিচার যেন আমি এই বাংলায় দেখতে পারি।'
সমাবেশে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, 'বিচার শুরু হয়েছে। এই বিচার এমনভাবে হবে, আগামী ১০০ বছরে তারা মীর জাফরে পরিণত হবে। যারা শহীদ ও আহত হয়েছে, তাদের সহযোগিতার জন্য সরকারের পাশাপাশি দলগুলোর মধ্যে লিয়াজোঁ কমিটি করে দেওয়া উচিত। শহীদদের রক্তের সঙ্গে যেন আমরা বেইমানি না করি।'
গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর বলেন, 'যারা আন্দোলন-সংগ্রামে ত্যাগ স্বীকার করেছে, শহীদ হয়েছে, তাদের যেন আমরা ভুলে না যাই।' আরও বক্তব্য রাখেন- গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, বিপস্নবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলের শীর্ষ নেতা এহসানুল হুদা, ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন প্রমুখ। এ ছাড়া বিএনপির শীর্ষ নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।