ব্যাংকিং খাতে মাত্র ৫ শতাংশের কিছু বেশি অ্যাকাউন্টে দুই লাখ টাকার বেশি আমানত রয়েছে। তবে এই ৫ শতাংশ অ্যাকাউন্টে মোট ব্যাংকিং খাতের আমানতের প্রায় অর্ধেক রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত বীমার পরিমাণ দ্বিগুণ করায় এখন ৯৫ শতাংশ গ্রাহক সুরক্ষিত রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে ৯৪.৬ শতাংশ অ্যাকাউন্টে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দুই লাখ টাকার নিচে রয়েছে। গেল সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত বীমার পরিমাণ দ্বিগুণ করে দুই লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। ফলে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত রাখা গ্রাহকরা এখন নিরাপদ।
তথ্য মতে, যদি কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয় বা উধাও হয়ে যায় সেই ব্যাংকে একজন গ্রাহকের যত টাকাই থাকুক না কেন বীমার আওতায় সে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কোনো গ্রাহকের হিসাবে এক কোটি টাকা থাকে সে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। এর আগে বীমার ক্ষতিপূরণ ছিল এক লাখ টাকা।
গত ৮ সেপ্টেম্বব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আমানত বীমা দ্বিগুণ করার বিষয়টি জানান। এর আগে, ব্যাংক আমানত বীমা আইন, ২০০০ (আমানত বীমা আইন) আমানতকারীদের ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বীমা সুবিধা দিত।
স্কিম অনুযায়ী, যদি কোনো বীমাকৃত ব্যাংক অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহলে ব্যাংক আমানতকারীকে তাদের জমাকৃত অর্থের সমান পরিমাণ অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রদান করবে। অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ কোনো ব্যাংকে কোনো ব্যক্তির একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকলে এবং জমার পরিমাণ ১ লাখ টাকার বেশি থাকলেও অর্থ পরিশোধের সীমা ১ লাখ টাকার বেশি হবে না। এখন ২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হবে।
তথ্য মতে, ব্যাংক খাতে মোট ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ৬৮৪ অ্যাকাউন্টে জমার পরিমাণ ১৭ লাখ ১৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ কোটি টাকার বেশি আমানত আছে- এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৫। এসব হিসাবে জমা আছে ৭ লাখ ২৭ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের মধ্যে প্রায় ৪৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ দখলে রেখেছেন কোটিপতিরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ১ কোটি ১ টাকা থেকে শুরু করে ৫ কোটি টাকার আমানতের হিসাব দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৭৬০টি। আমানত ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। ৫ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটির ১২ হাজার ২২১টি হিসাবে সঞ্চয় ৮৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ৪ হাজার ৭৪; ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৯৬৮; ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ২৭৪ এবং ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটির মধ্যে ৯১৯টি আমানতকারীর হিসাব। ৩০ কোটি থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫১২টি এবং ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩৪৩টি, ৪০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৭৪৭টি। এছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা ১ হাজার ৭৭৮। ৫ বছরে ব্যাংকে নতুন কোটিপতি ৩০ হাজারের বেশি বলে জানা গেছে।
এদিকে মে মাস থেকে ব্যাংকে বাড়তে শুরু করেছে আমানতের পরিমাণ। এপ্রিল মাসের তুলনায় পরের মাসে ব্যাংক আমানত ৪১ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসে ব্যাংক আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। তার আগে মে মাসে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকে আমানত ছিল ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর আমানত দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৫৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। ফেব্রম্নয়ারিতে এসে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। মার্চে গিয়ে আমানতের পরিমাণ ১৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এপ্রিল মাসে আমানত কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর সুদের হার বৃদ্ধির নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোর তারল্যসংকট কাটাতে এবং ঋণের চাহিদা মেটাতে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে থাকে। যার ফলে মে মাস থেকে আমানতের ধারা ব্যাপক ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। আর জুন মাসে সেই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা।
আমানত বীমা সম্পর্কে গভর্নর বলেন, আমানত বীমার পরিমাণ ১ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আমানতকারীদের ৯৪.৬ শতাংশ সঞ্চয় সম্পূর্ণ সুরক্ষিত হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশই আমানতকারীদের শতভাগ অর্থের নিশ্চয়তা দিতে পারে না, আমরাও পারি না। যদি একটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়, ছোট আমানতকারীরা তাদের টাকা অবিলম্বে ফেরত পাবেন। আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার শুরু হয়েছে। তা চলমান আছে। এই মুহূর্তে, আমাদের মূল লক্ষ্য আমানতকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা যায়, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে থাকা মানুষের মধ্যে মাত্র ৫.৮৫ শতাংশ মানুষের ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। যদিও বর্তমানে দেশে ৬১টি ব্যাংক রয়েছে। ৬৪ জেলায় ব্যাংকগুলোর প্রায় ১১ হাজার শাখা রয়েছে। কিন্তু সেখানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের। এতগুলো ব্যাংকের কাজ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই জরিপ নিয়ে আপত্তি আছে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের মতে, মাত্র ৫ শতাংশ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সন্তোষজনক নয়, মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। মূলত ব্যাংকিং সেবায় নানা জটিলতার কারণে ব্যাংক লেনদেনের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। যার ফলে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার হার কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে মোবাইল ব্যাংকিং সহজ এবং প্রান্তিক পর্যায়ে তাদের সেবা পৌঁছে দিতে পারছে। এ কারণে মানুষ এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলা নিয়ে আগ্রহ কম থাকলেও আর্থিক লেনদেনে এগিয়ে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং।