শুক্রবার বিকাল তিনটা পর্যন্ত একটানা ভারী বর্ষণে পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহর ও টেকনাফের অন্তত ৯০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। শহরের প্রধান সড়ক, হোটেল-মোটেল জোন, সৈকত সড়ক, উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ প্রায় ৩০টি উপ-সড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। পানি ঢুকেছে শহর এবং সৈকতের পাশের বেশির ভাগ হোটেলের নিচতলায়। এতে সড়কে যানচলাচল অনেকটা বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন বহু পর্যটক। আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে, যা চলতি মৌসুমে একদিনে সর্বোচ্চ। এদিকে, জেলায় পৃথক দু'টি স্থানে পাহাড় ধসে ছয়জন নিহত হয়েছেন।
জানা গেছে, সাগরে নিম্নচাপের ফলে সমুদ্রশহর কক্সবাজারে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকেই ভারী বর্ষণ শুরু হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুক্রবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত কক্সবাজার শহরের পর্যটন জোনের কলাতলী, প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, টেকপাড়া, কালুরদোকান, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, বাস টার্মিনাল এলাকাসহ বেশিরভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে শহরের যান চলাচল বিঘ্ন সৃষ্টির পাশাপাশি জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হলেও ভারী বর্ষণ শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে। এরপর রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টার ভারী বর্ষণ পুরো শহরের আট লাখ মানুষের কর্মজীবন অনেকটাই থামিয়ে দেয়। এমন ভারী বর্ষণ গত ৫০ বছরে দেখেননি কেউ।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বার্তায় জানানো হয়েছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে যেতে পারে। কক্সবাজারসহ চার সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান বলেন, বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা থেকে শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি মৌসুমে একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এমন ভারী বর্ষণ এ জীবনে তিনি দেখেননি। বর্ষণে পর্যটন শহরের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
শহরের পাহাড়তলী বৈইলস্না পাড়ার বাসিন্দা বাবুল বড়ুয়া জানান, টানা বর্ষণে পাহাড়তলীর তিনটি সড়ক ডুবে কয়েকশ' ঘরবাড়ি ও পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে নারী-শিশুরা চরম দুর্ভোগ আছে।
পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল জানান, ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বন্দরপাড়া, উত্তর নুনিয়াছটার কয়েকশ' ঘরবাড়ি বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে রান্নাবান্না বন্ধ থাকায় হাজার হাজার মানুষ খাবার ও পানীয় জল সংকটে আছেন।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ভারী বর্ষণ হলেই হোটেল-মোটেল জোনে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তখন পর্যটকরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব বিরাজ করে।
পাহাড় কাটার কারণে সে মাটি বৃষ্টির পানিতে নিচের দিকে নেমে পানি চলাচলের নালা ভরাট হয়ে গেছে। ফলে দ্রম্নত পানি নিষ্কাশন হতে না পারায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। গত জুলাই মাসেও কয়েক দফায় ভারী বর্ষণে শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল বলেও জানান তিনি।
এমন জলাবদ্ধতা আর চোখে পড়েনি জানিয়ে শহরের তারাবুনিয়াছড়ার বাসিন্দা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আয়াছুর রহমান বলেন, শহরের ময়লা-আবর্জনায় নালা-নর্দমা ভরে আছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নালা দিয়ে নেমে যেতে পারছে না বলেই শহরজুড়ে এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল গনি ওসমানী বলেন, টানা বৃষ্টিতে কক্সবাজারের শতাধিক গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন তাদের সরিয়ে আনতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন।
পাহাড়ধসে ৬ জনের মৃতু্য
কক্সবাজার ও উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, জেলায় পৃথক স্থানে দু'টি পাহাড় ধসের ঘটনায় দুই পরিবারের ছয়জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজায় একই পরিবারের তিনজন ও উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। ভারী বর্ষণ চলাকালে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপ-সহকারী পরিচালক মো. তানহারুল ইসলাম বলেন, পাহাড় ধসে জেলা সদরের দক্ষিণ ডিককুলের মিজানুর রহমানের স্ত্রী আঁখি মণি (২৮), মেয়ে মিহা জান্নাত (১২) ও লতিফা ইসলাম (৯) নিহত হন। এছাড়া উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৪ নম্বর ক্যাম্পের ই-২ বস্নকের কবির আহমেদের ছেলে আব্দুর রহিম, আব্দুল হাফেজ এবং আব্দুল ওয়াহেদ নিহত হন।
নিহতের স্বজনরা জানান, রাত ২টার দিকে ভারী বৃষ্টি হওয়ার সময় মিজানের বাড়ির দিক থেকে একটি পাহাড় ধসের বিকট শব্দ শুনতে পান এলাকাবাসী। এ সময় তারা এগিয়ে গিয়ে দেখে মিজানের বাড়ির ওপর পাহাড়ের একটি অংশ ধসে চাপা পড়েছে। মিজানকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও তার স্ত্রী ও দুই সন্তান মাটি চাপা পড়ে। পরে ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় তাদের তিনজনের মরদেহ বের করে আনা হয়।
কক্সবাজার ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সামশুদ্দৌজা নয়ন জানান, টানা বর্ষণের কারণে উখিয়ার ১৪ নম্বর হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে তিনটি ঘর সম্পূর্ণ ধসে গেছে। এতে একই পরিবারের তিনজনের মৃতু্য হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, আজ সকালে ঝিলংজায় ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত তিনজনের পরিবারকে ৭৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনা হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চারটি পৃথক টিম মাঠে নেমেছে।
ডুবে গেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ ১৫শ' ঘরবাড়ি
এদিকে ভারী বর্ষণে জেলার টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ স্থানীয়দের দেড় হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। এতে ৬ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি-চিংড়ি ঘেরও। প্রাণহানি রোধে পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করছে উপজেলা প্রশাসন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, টেকনাফ পৌরসভার, সাবরাং, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সদর ইউনিয়নের বসবাসকারী ৮০০ পরিবারের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এছাড়া টেকনাফের লেদা, জাদিমুড়া ও আলীখালী ক্যাম্পের ৭০০ ঘর ডুবে গেছে। পাশাপাশি প্রাণহানি রক্ষায় টেকনাফ পৌরসভায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে বলেছে উপজেলা প্রশাসন।
শুক্রবার টেকনাফের ইউএনও মো. আদনান চৌধুরী বলেন, 'ভারী বর্ষণে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং, সদর ও পৌরসভাসহ বিভিন্ন গ্রামে হাজারের কাছাকাছি ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। আমরা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। পাশাপাশি অতিভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সকাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হয়েছে।'
ভারী বর্ষণে পানিবন্দি টেকনাফ সদরের বাসিন্দা নুর কামাল বলেন, 'বাড়িতে পানি ঢুকেছে। ফলে ঘরের সব কিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। সকাল থেকে শুধু মুড়ি খেয়ে দিন পার করছি। কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি। আমাদের আশপাশের ৩৫টি পরিবার রয়েছে। সবার ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। মূলত খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নামতে পারেনি। ফলে আমরা সবাই পানিবন্দি।'
হ্নীলা বাসিন্দা মোহাম্মদ রাসেল বলেন, 'ভারী বৃষ্টিতে আমাদের অনেক গ্রাম তলিয়ে গেছে। এতে হাজারও মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের কষ্টের শেষ নেই। তবে প্রশাসনের পক্ষ হতে আগ থেকে কোনো সর্তক বার্তা দেওয়া হয়নি ভারী বৃষ্টির বিষয়ে।'
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, 'ভারী বর্ষণে আমার এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের ৫০০ ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। এমনকি প্রধান সড়কে পানি উঠেছে। আমরা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি।'
এদিকে টেকনাফ লেদ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ আলম বলেন, 'ভারী বৃষ্টিতে ক্যাম্পের অনেক ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। এতে নারী-শিশুদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। যেসব রোহিঙ্গা ঘরে থাকতে পারছে না তাদের আমরা সহায়তা করছি।'