শিল্প উৎপাদনে ভাটা

শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাস-বিদু্যতের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ৪০ থেকে ৬০% কমেছে। এর ওপর শ্রমিক ও কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে শিল্প খাতের চলমান স্থিতিশীলতা 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে

প্রকাশ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
পোশাক ও বস্ত্রসহ ভারী-মাঝারি শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাস-বিদু্যতের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ কমেছে। বিদেশি ক্রেতাদের 'অর্ডার' ধরে রাখতে অনেকে জেনারেটরে ডিজেল-পেট্রোল পুড়িয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রেখেছেন। তবে এতে শিল্পমালিকদের ঘাড়ে অতিরিক্ত খরচের বোঝা চাপছে। এ পরিস্থিতিতে শিল্প উৎপাদনে ভাটার টান ধরেছে। এর ওপর শ্রমিক-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে শিল্প খাতের চলমান অস্থিতিশীলতা 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশকিছুদিন ধরেই গাজীপুর ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষকে ঘিরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সড়ক অবরোধ, শিল্প কারখানা ভাঙচুর, এমনকি অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। বেশকিছু কারখানায় শ্রমিকদের কর্মবিরতি চলমান থাকায় বিপুলসংখ্যক বিদেশি ক্রয়াদেশ (অর্ডার) বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম জানান, বৃহস্পতিবার শিল্পাঞ্চলের কোথাও কোনো সড়ক অবরোধসহ কোনো কারখানায় হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা না ঘটলেও সেখানকার মোট ২১৯টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ৮৬টি কারখানা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা (নো ওয়ার্ক নো পে) মোতাবেক বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আর ১৩৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। শিল্পাঞ্চলে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কারখানাগুলোর সামনে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। এছাড়া শিল্পাঞ্চলে যৌথবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে। তবে শিল্পমালিকরা মনে করেন, এ ধরনের তৎপরতা চালিয়ে হয়তো বিশৃঙ্খলা এড়ানো যাবে, নাশকতা ঠেকানো যাবে। কিন্তু উৎপাদন পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এতে বায়ারদের কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে এয়ারফ্রেট (উড়োজাহাজীকরণ) করতে হবে। ফলে তারা মোটা অঙ্কের লোকসানের ঝুঁকিতে পড়বেন। তবে কোনো কোনো শিল্পকারখানার পক্ষে এয়ারফ্রেট করেও মাল পৌঁছানোর সময় পাবে না। এতে তাদের অর্ডার বাতিল হবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিল্প খাতে বড় ধস নামবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা। এদিকে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে গার্মেন্টস খাতের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে দাবি করলেও শিল্প পর্যবেক্ষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, কারখানা শ্রমিকদের বিক্ষোভের পেছনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। শিল্প খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য তৃতীয় পক্ষ ইন্ধন দিচ্ছে। তবে শ্রমিক নেতারা বলছেন, সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে অনেক শ্রমিকও মারা গেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও নিয়োগ ও বেতন বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলোতে কারখানায় শ্রমিকরা যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিলেন তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ নিয়ে কারখানা শ্রমিকরা মালিকদের কাছে তাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরেন। তারা আন্দোলনেরও হুমকি দেন। কিন্তু শিল্পমালিকরা তাতে কর্ণপাত না করে তাদের ভিন্ন কৌশলে প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালান। স্থানীয় জুট ব্যবসায়ীদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টাও চালান গার্মেন্টস মালিকদের কেউ কেউ। যা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সরকারের পটপরিবর্তনের পর জুট ব্যবসায়ীদেরও হাতবদল হয়েছে। ফলে আন্দোলন ঠেকানোর তৎপরতা উল্টো নতুন ও পুরনো জুট ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রম্নতিতে শিল্প খাতে চরম অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এছাড়া আওয়ামী লীগ সমর্থিত শ্রমিক নেতাদের হটিয়ে দিয়ে সেখানে নতুন নেতাদের আধিপত্য দখলের ইসু্যটিও শিল্প খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ পরিস্থিতি তৈরিতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরও হাত রয়েছে। তারা এ ইসু্যটিকে পুঁজি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চাপে রাখতে চায়। পাশাপাশি শিল্পকেন্দ্রিক অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেওয়ারও ষড়যন্ত্র করছে। এদিকে আশুলিয়া ও গাজীপুরসহ গুটি কয়েক শিল্প এলাকার কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করলেও গোটা দেশের শিল্প খাতে গ্যাস-বিদু্যতের তীব্র সংকট গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। শিল্পমালিকরা জানান, তারা তাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ শতাংশই এখন ব্যবহার করতে পারছে না। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ শহরের বাবুরাইল, পাইকপাড়া, ভূঁইয়াপাড়া, নয়াপাড়া, শীতলক্ষ্যা, মন্ডলপাড়া, টানবাজার, গলাচিপা, কলেজ রোড, মাসদাইর, চাঁদমারী, মিশনপাড়া, আমলাপাড়া, ডনচেম্বার, হাজীগঞ্জ, ফতুলস্নার কাঠেরপুল, দক্ষিণ সস্তাপুর, ইসদাইরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস-সংকট রয়েছে। পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরী, ফতুলস্নার শিল্পাঞ্চলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাসের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গাজীপুরের শ্রীপুরের একটি স্পিনিং মিলস মালিক রাজীব আহমেদ জানান, ক্রয়াদেশ মোটামুটি ভালো থাকলেও গ্যাস-সংকটের কারণে পণ্য সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সময়মতো সরবরাহ দিতে না পারলে মুশকিলে পড়তে হবে। তিনি আরও বলেন, উৎপাদন কমে যাওয়ায় তার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে কোম্পানির নগদ অর্থের প্রবাহ কমেছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া নিয়ে তাই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। শুধু শ্রীপুরের ওই কারখানাই নয়, বিপুলসংখ্যক বস্ত্রকল দীর্ঘদিন ধরে তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে। বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর নেতারা বলছেন, গ্যাস-সংকটে দেশের ৭০-৮০ শতাংশ বস্ত্রকলের উৎপাদন গড়ে ৪০ শতাংশে নেমেছে। এতে তৈরি পোশাক কারখানায় সময়মতো কাঁচামাল পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর ফলাফল দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের আয়ে দেখা যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিটিএমএ নেতারা। বস্ত্র খাতের মতোই তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে সিরামিক শিল্পও। এটি আরেকটি খাত, যেখানে বিপুল পরিমাণে গ্যাসের ব্যবহার হয়। সিরামিক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিসিএমইএর নেতারা বলছেন, তীব্র গ্যাস-সংকটে ২২-২৫টি সিরামিক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কারখানাগুলোয় গ্যাসের চাপ যেখানে ১৫ পিএসআই (পাউন্ডস পার স্কয়ার ইঞ্চি) প্রয়োজন হয়, সেখানে গ্যাসের চাপ এর থেকে অনেক নিচে। ফলে এসব কারখানায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার উৎপাদন ক্ষতি হচ্ছে। এদিকে বিদু্যৎ সরবরাহের ঘাটতিও শিল্পকারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিল্পমালিকদের ভাষ্য, প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় তা ৪ থেকে ৫ ঘণ্টাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতে উৎপাদনে বড় ধস নেমেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেক শিল্পমালিক তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন। এ পরিস্থিতিতে কারখানার মালিকরা অন্তর্র্বর্তী সরকারকে গ্যাস-বিদু্যৎ পরিস্থিতি উন্নত করতে দ্রম্নত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, জ্বালানি সংকটের কারণে বেশিরভাগ কারখানা এখন ৩০ শতাংশ সক্ষমতা নিয়ে চলছে। এছাড়া পোশাক কারখানাগুলো উৎপাদন চলমান রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় জরুরি ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলার উন্নতির আহ্বানও জানিয়েছেন তারা। বিটিএমএর সহ-সভাপতি মো. সালেদ জামান খান বলেন, গত আট মাস ধরে ভুলতা, গাউসিয়া, রূপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে বস্ত্র কারখানার মালিকরা গ্যাসের চাপ কম থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। ডিজেল, সিএনজি ও পেট্রোলিয়াম গ্যাস দিয়ে বস্ত্র কারখানা চালানো হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কারখানাগুলো মাত্র ৩০ শতাংশ সক্ষমতা নিয়ে চলছে। সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়ছে। এদিকে গ্যাস ও বিদু্যৎ সংকট সহসাই কেটে গিয়ে শিল্প উৎপাদন স্বাভাবিক পর্যায়ে আসবে এমনটা আশা করতে পারছেন খোদ এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ এর চেয়ে কমলেই বেড়ে যায় সংকট। এখন সরবরাহ আগের চেয়েও বেশ কমেছে। তিতাসের গাজীপুর শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গাজীপুরে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৬০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ হচ্ছে ৪০ কোটি ঘনফুট। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে কবে নাগাদ এ সংকট কাটবে তা অনিশ্চিত।