লোডশেডিং ছাড়িয়েছে আড়াই হাজার মেগাওয়াট
বিদু্যৎ পরিস্থিতির আরও অবনতি
প্রকাশ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রেজা মাহমুদ
দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বেড়েই চলছে। বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে লোডশেডিং ছাড়িয়েছে ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তবে প্রকৃত লোডশেডিং পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। যা দেশের গড় বিদু্যতের চাহিদার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। বিদু্যৎ পরিস্থিতির এমন অবনতিতে একদিকে বেড়েছে জনভোগান্তি, অন্যদিকে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন।
চলমান এ সংকটের গুরুত্ব বিবেচনায় বিদু্যৎ উৎপাদন স্বাভাবিকের চেষ্টা থাকলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি আমদানি, দেশি-বিদেশি সংস্থার বকেয়া পরিশোধের চাপ ও অভ্যন্তরীণ উৎস হতে কাঙ্ক্ষিত জ্বালানি উত্তোলন করতে না পারা। সব মিলিয়ে বিদু্যৎখাতে এক ধরনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যদিও সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছে অর্থ সহায়তা চেয়েছে। কিন্তু এ সহায়তা পেতে অপেক্ষা করতে হতে পারে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)-র ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় দেশে বিদু্যতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২২৯ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ করা গেছে ১৩ হাজার ৯৩৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ২৯১ মেগাওয়াট। আর সোমবার লোডশেডিং হয়েছে ১৯৭৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। সেদিন রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। তবে বুধবার কিছুটা কমে লোডশেডিং হয়েছে ১০৪০ মেগাওয়াট। কিন্তু সারাদেশে অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা ও সরবরাহের হিসাব বলছে দিনে অন্তত আড়াই হাজার মেগাওয়াট করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।
বিপিডিবির তথ্য বলছে, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদু্যৎকেন্দ্র বন্ধ আছে। অন্যদিকে জ্বালানি সংকটে দেশে ৬ হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন কমেছে। বিদু্যতে প্রতিদিন গড়ে ৮৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, যা এপ্রিলে ছিল ১৩৫ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি
\হটার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। পেট্রোবাংলা প্রতিদিন সরবরাহ করছে ২৫৯ ঘনফুট গ্যাস।
জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি কমেছে ভারত থেকে বিদু্যৎ আমদানির পরিমাণও। ত্রিপুরা থেকে ঘণ্টায় ১৬০ মেগাওয়াটের স্থানে ৬০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ভেড়ামারা দিয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ আসার কথা থাকলেও মিলছে ৮৮০ মেগাওয়াট। আদানির বিদু্যৎকেন্দ্র থেকেও ৪০০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ কম আসছে।
এদিকে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের ৫ বিদু্যৎ কোম্পানির প্রায় ১০০ কোটি ডলার পাওনা। এই বকেয়ার মধ্যে আদানি পাওয়ার পাবে প্রায় ৮০ কোটি ডলার। ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরা বলেছেন, বকেয়া থাকার পরও বাংলাদেশে বিদু্যৎ সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। তবে সতর্ক করে তারা বলেছেন, এই অবস্থা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। কারণ বিদু্যৎ কোম্পানিগুলো অংশীদারদের কাছে দায়বদ্ধ।
অন্যদিকে বিদু্যৎখাতে দেশ এবং দেশের বাইরে বকেয়ার পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু ভারতের ৫টি প্রতিষ্ঠানই পাবে ১০০ কোটি ডলারের বেশি। এর বাইরে বাকিটা পাবে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। সেই টাকা দিতে না পারার কারণে এলএনজি আমদানিতেও সংকট হচ্ছে, আনা যাচ্ছে না কয়লাও।
এমন পরিস্থিতিতে সংকটে পড়ছে শিল্পখাত। কমে গেছে কারখানার উৎপাদন। জেনারেটরের ওপর ভরসা করতে গিয়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, চলমান লোডশেডিংয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে পোশাকখাতে। এখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রডাক্ট ডেলিভারী করতে হয়। তাই যে কোনো উপায়ে কারখানা সচল রাখতে হয়। দেখা গেছে এ খাতে ওয়াশিং, নিটিং ও ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলোতে হঠাৎ বিদু্যৎ চলে গেছে পুরো প্রোডাক্টই বাতিল হয়ে যেতে পারে। এতে লোকসানে ঝুঁকি বেড়ে যায়। আবার জেনারেটর দিয়ে কারখানা চালালে খরচ পুষিয়ে নেওয়াটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।
গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি বেশ খারাপ। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে ঘন ঘন বিদু্যৎ যাওয়ায় গ্রাহকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উত্তরের ১৬ জেলায় পলস্নী বিদু্যৎ ও নেসকো মিলে বিদু্যতের চাহিদা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু গত দু'দিন ধরে সরবরাহ মিলছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি এখন যেখানে এসে পৌঁছেছে সেখান থেকে রাতারাতি কোনো সমাধান নেই। আপাতত বিকল্প জ্বালানির সরবরাহ বাড়িয়ে অর্থাৎ ব্যয়বহুল হলেও তেলচালিত কিছু কেন্দ্র চালু করা যেতে পারে। এতে লোড শেডিংয়ের মাত্রা কিছুটা হলে কমবে। এছাড়াও সামিটের এলএনজি টার্মিনাল সচল করা গেলে জ্বালানির সরবরাহ আরও কিছুটা বাড়বে।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে বলেন, 'জ্বালানি সংকটে বিদু্যতের কিছু ঘাটতি আছে। আমরা সেই ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা যায় তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছি, চেষ্টা করছি সমস্যা সমাধানের'।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-র সাবেক সদস্য মকবুল ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, 'এখনই দু'টি কাজ করতে পারলে ৮০ ভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রথমত চুরি বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেক জোনে একটা মিটার বসাতে হবে। তারা কতটুকু বিদু্যৎ নিচ্ছে আর তার বিনিময়ে বিল কত দিচ্ছে? তাহলেই বোঝা যাবে কোন জোনে চুরি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। তাদের ধরতে হবে। আর দ্বিতীয়ত হলো, গ্যাসের কুয়াগুলোকে একটু ঝালাই মোছাই করলে আগামী এক মাসের মধ্যে ১৫০ মিলিয়ন গ্যাস অতিরিক্ত পাওয়া যাবে। সেই কাজটাও কেউ করছে না।
তবে বিদু্যৎ ঘাটতি মেটাতে সরকার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, 'অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি ও কয়লা আমদানি করা হচ্ছে। তবে বিদু্যৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে।