গাইবান্ধা জেলায় যৌথবাহিনীর অভিযানে একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ যে পাঁচজনকে সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে দুজন মারা গেছে। তাদের 'পিটিয়ে মেরে ফেলার' অভিযোগ তুলছেন পরিবারের সদস্য ও অন্য আটককৃতরা। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ বলছে, তাদের কোনো অসুস্থতা ছিল।
হাসপাতালে ভর্তির সময় তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে সেগুলোই মৃতু্যর কারণ কি না তা নিয়ে সন্দিহান তারা। বাকি আটকরাও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
গাইবান্ধার সাঘাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন সুইটের বাসায় গিয়ে 'অস্ত্র উদ্ধারের পর' সুইটসহ বাকিদের গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথবাহিনী। বাকি চারজন ইউপি চেয়ারম্যানের প্রতিবেশী ও স্বজন। তারা হলেন- শফিকুল ইসলাম, সোহরাব হোসেন আপেল,
সাহাদত হোসেন ও রিয়াজুল ইসলাম।
এদের মধ্যে শফিকুল ইসলাম ও সোহরাব হোসেন মঙ্গলবার দুপুরে মারা যান।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চেয়ারম্যান ও তার ভাইদের 'সিন্ডিকেট চক্রকে' গ্রেপ্তার করে শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসী কয়েক দফায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক জিলস্নুর রহমান পলাশ। তাদের বিরুদ্ধে নদীর চর দখল ও অবৈধভাবে বালু তোলার অভিযোগও রয়েছে স্থানীয়দের।
'পাঁচ মিনিট যদি রেস্ট দেয়, দশ মিনিট পেটায়'
নিহতদের মধ্যে সোহরাব হোসেন আপেল গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে মারা যান। শফিকুল ইসলাম মারা যান বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সদর হাসপাতালে আপেলের স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা গেছে।
সুইটসহ অন্যরাও চিকিৎসাধীন রয়েছেন সেখানে। তারা জানান, সোমবার রাত ১২টায় তাদের বাড়িতে অভিযানে যায় যৌথবাহিনীর সদস্যরা। তার বাসায় তলস্নাশি চালিয়ে অভিযানকারীরা কিছু পায়নি বলে দাবি করেন মোশাররফ হোসেন সুইট। যদিও গ্রেপ্তারের পর তোলা ছবিতে কয়েকটি দেশি অস্ত্র দেখা যায়।
হাসপাতাল বেডে শুয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সাহাদত হোসেন। তিনি জানান, স্থানীয় বাজার থেকে তাকে আটক করা হয়। নিয়ে আসা হয় ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে।
সাহাদত বলেন, 'পেছন থেকে বাড়ি শুরু করছে। বলে, তোরা চেয়ারম্যানের ক্যাডার... পাঁচ মিনিট যদি রেস্ট দেয়, দশ মিনিট পেটায়।'
নিহত সোহরাব হোসেন আপেলের স্ত্রীর দাবি, পরিবারের সবাইকে একটা রুমে আটকে রেখে আপেলকে মারধর করা হয়। তিনি বলেন, 'আমার স্বামীর কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। সে দাপাচ্ছিল।'
আপেলের স্ত্রীর চাচাতো ভাই মো. বিপস্নব বলেন, 'প্রশাসন যে একটা লোককে মারতে মারতে মাইরে ফেলায় দিবে, এটা আমাদের জানা ছিল না।'
মোশাররফ হোসেন সুইটের অভিযোগ, ভোর পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। তিনি বলেন, 'রাত ১২টা থেকে মাইর শুরু করছে ভোর ৬টা পর্যন্ত মারছে। ৬টার সময় তারা বলতেছে রামদা আছে।'
পুলিশ কী বলছে?
গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র?্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসারের সমন্বয়ে যৌথ আভিযানিক দল করে সারাদেশে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু করা হয়। চলমান এই অভিযানের অংশ হিসেবে যৌথবাহিনীর সদস্যরা সাঘাটা উপজেলায় অভিযান চালান বলে জানান গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মো. মোশারফ হোসেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও জানান, সেখানে সাঘাটা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন সুইট ও তার সঙ্গীদের বাড়ি থেকে ককটেল ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় মি. সুইটসহ পাঁচজনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুলিশ সুপার বলেন, 'থানায় নেওয়ার আগে যেহেতু আসামিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিয়ম রয়েছে, সেজন্য তাদের সবাইকে সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে নেওয়া হয়েছিল।'
সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সোহরাব হোসেন আপেলকে জেলা সদর হাসপাতালে এবং শফিকুল ইসলামকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। পরে ওই দুই হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃতু্য হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আটক করার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনেই আপেল এবং ইসলামের মৃতু্য হয়েছে বলে নিহতদের স্বজনরা যে অভিযোগ তুলেছেন তা অস্বীকার করেছেন পুলিশ সুপার মি. হোসেন। তবে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে আটকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
শরীরে আঘাতের চিহ্ন
সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স থেকে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের চারজনকে সদর হাসপাতালে যখন আনা হয় তখন তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. মাহাবুব রহমান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
নিহত সোহরাব হোসেন আপেলের পায়ে আঘাত ছিল বলে জানান আবাসিক চিকিৎসক আসিফুর রহমান। তবে সেই আঘাতের জন্য মৃতু্যর হওয়া 'অপ্রত্যাশিত' বলে মনে করেন তিনি।
মাহাবুব রহমান বলেন, 'ওনার পায়ে আঘাত ছিল, সেটার জন্য মারা গেলেন, এটা অপ্রত্যাশিত, কোনো অভ্যন্তরীণ রোগ বা জটিলতা থেকে থাকতে পারে।' তবে, মৃতু্যর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পোস্ট মর্টেমের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেন তিনি।