যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জনমত জরিপে এগিয়ে থাকা দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাটিক দলীয় প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম নির্বাচনী বিতর্কে মুখোমুখি হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় সময় মঙ্গলবার রাতে পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের বৃহত্তম শহর ফিলাডেলফিয়ায় বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানেই ট্রাম্পের সঙ্গে হ্যারিসের প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ হয় এবং হ্যারিস এগিয়ে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে করমর্দন করেন।
বিতর্কে স্বভাব সুলভভাবে আক্রমণাত্মক রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ট্রাম্পকে রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দেন সাবেক আইনজীবী হ্যারিস।
বিতর্কের শুরু থেকেই ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের মতো শারীরিক সামর্থ্য তার আছে কি না, তার অগণিত আইনি সমস্যা ও গর্ভপাতের সীমা নিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন হ্যারিস। অপ্রত্যাশিত এ আক্রমণের মুখে রক্ষণাত্মক অবস্থানে গিয়ে বিতর্ক চালিয়ে যান ট্রাম্প।
বিভিন্ন জনমত জরিপগুলোতে হোয়াইট হাউজের দৌড়ে এ দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে। এ পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ মুখোমুখি বিতর্ক একটি প্রচার পরিবর্তনকারী মুহূর্ত ছিল। এই সুযোগকে নিজের পক্ষে আনার চেষ্টায় উভয় প্রার্থীই জোরালোভাবে নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
রয়টার্স জানিয়েছে, সাবেক আইনজীবী কমলা হ্যারিস (৫৯) বারবার ট্রাম্পকে বিরক্ত করে
\হমিথ্যা ভরা জবাব দিতে প্ররোচিত করেছেন, আর তাতে ট্রাম্প (৭৮) দৃশ্যতই ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন।
বিতর্কের এক পর্যায়ে হ্যারিস বলেন, লোকজন 'একঘেয়েমিতে ভুগে ক্লান্ত হয়ে' আগেভাগেই ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার জনসমাবেশগুলো ছেড়ে চলে যায়। ট্রাম্প উত্তেজিত হয়ে উঁচু গলায় এর জবাব দেন।
হ্যারিসের জনসভাগুলোতে উপস্থিত লোকজনের পরিমাণ দেখে হতাশ হয়ে ওঠা ট্রাম্প এদিন বলেন, "আমাদের জনসমাবেশগুলো, আমাদের জনসমাবেশগুলোই সবচেয়ে বড়, রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য সব সমাবেশ।"
"আবারও সীমা ছাড়া কথাবার্তা," উত্তরে হাসতে হাসতে বলেন হ্যারিস।
দুই প্রার্থী অভিবাসন, পররাষ্ট্র নীতি ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিতর্কে জড়ান; কিন্তু সুনির্দিষ্ট নীতিগত বিবরণের গভীরে কেউই প্রবেশ করেননি। হ্যারিসের আক্রমণাত্মক ধরন ট্রাম্পকে চাপে রাখতে সফল হয়।
হ্যারিসকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বর্ণবাদী ও লিঙ্গবাদী আক্রমণের মতো ব্যক্তিগত আক্রমণ করে আসা ট্রাম্প বিতর্কের প্রথম দিকে এ ধরনের অপমান করা থেকে অনেকটা বিরত ছিলেন, কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে হ্যারিসের আক্রমণের মুখে তিনি ততই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন।
এরই এক পর্যায়ে তিনি প্রতিপক্ষের বর্ণ নিয়ে মন্তব্য করলে জবাবে কমলা হ্যারিস বলেন, "এটি একটি শোচনীয় ঘটনা যে আমাদের একজন যিনি প্রেসিডেন্ট হতে চান তিনি তার পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে মার্কিন জনগণকে জাতিগতভাবে বিভক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।"
একজন পর্ন তারকাকে গোপনে অর্থ প্রদান নিয়ে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া, তার বিরুদ্ধে থাকা অন্যান্য অভিযোগ ও যৌন নিপীড়নের দায়ে দোষী হওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের সমালোচনা করেন হ্যারিস।
এর জবাবে ট্রাম্প কোনো অন্যায় করার কথা অস্বীকার করেন এবং কোনো প্রমাণ ছাড়াই তার বিরুদ্ধে এসব মামলা করার জন্য ফের হ্যারিস ও ডেমোক্র্যাট পার্টিকে অভিযুক্ত করেন।
প্রতারণার কারণে ২০২০ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন বলে ফের মিথ্যা দাবি করেন ট্রাম্প। হ্যারিসকে 'মাক্র্সবাদী' বলে অভিহিত করেন এবং অভিবাসীরা সহিংস অপরাধের বিস্তার ঘটাচ্ছে বলে মিথ্যা দাবি করেন।
৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আট সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত এ বিতর্ক টেলিভিশনে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক কোটি ভোটার।
বিতর্কের খুঁটিনাটি
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের বিতর্কটা কয়েকটি বিষয়ে 'প্রথম' হয়ে রইল। এর একটি, আসছে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর এটাই প্রথম সরাসরি টেলিভিশন বিতর্ক।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ৯টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার সকাল ৭টায়) সম্প্রচারমাধ্যম এবিসি নিউজের আয়োজনে এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।
বিতর্ক মঞ্চে উঠেই সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেন বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা। দু'জন করমর্দন করেন। বিবিসি বলছে, এই প্রথম তারা মুখোমুখি হলেন, পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন করলেন।
বেশ সাবলীলভাবে বিতর্ক এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে কমলার একটি খোঁচায় পরিবেশ খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশ নিয়ে কমলা বলেন, সেখানে লোকেরা একঘেয়েমি ও ক্লান্তি থেকে তাড়াতাড়ি চলে যায়। এরপর ট্রাম্পও কমলার বিরুদ্ধে কণ্ঠ চড়ান।
সীমান্ত ও অভিবাসন নিয়ে কমলার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন ট্রাম্প। অর্থনীতি ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়েও সরব হয়ে ওঠেন তিনি। বাইডেন প্রশাসনের অংশ হিসেবে তিনি (কমলা) কেন আরও বেশি নীতিগত লক্ষ্য অর্জন করেননি, সেসব নিয়েও প্রশ্ন করেন ট্রাম্প।
দেশজুড়ে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের দিকে আঙুল তোলেন কমলা। আরেক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ট্রাম্প আদৌ সক্ষম (ফিট) কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে হামলা এবং 'দুর্বল ও ভুল জাতীয় নিরাপত্তানীতি, পররাষ্ট্রনীতির' জন্যও বিতর্কে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কমলা তোপ দাগেন।
বিতর্কে ট্রাম্প বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে একজন 'অস্তিত্বহীন' প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যা দেন। জবাবে কমলা বলেন, 'নির্বাচনে আপনি বাইডেনের বিরুদ্ধে লড়ছেন না, আপনি লড়ছেন আমার বিরুদ্ধে।'
বিতর্কের শেষ পর্যায়ে এসে ট্রাম্প বলেন, বাইডেন ও কমলা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট।
এর আগে কমলা বলেন, ট্রাম্প খুব সহজেই বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ নেতাদের দিয়ে প্রভাবিত হন। তাকে (ট্রাম্প) নিয়ে বিশ্বনেতারা হাসাহাসি করেন।
বিতর্ক শেষ হওয়ার পরপরই ৩৪ বছর বয়সি মার্কিন গায়িকা টেলর সুইফট এবারের নির্বাচনে কমলাকে ভোট দেওয়ার ঘোষণা দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে সুইফট বলেন, তিনি কমলাকে ভোট দেবেন। কারণ, তিনি অধিকারের জন্য লড়াই করেন। আর তিনি (সুইফট) বিশ্বাস করেন, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য একজন যোদ্ধার প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, কমলা একজন প্রতিভাবান নেত্রী।
পোস্টের শেষে সুইফট নিজের নাম লিখে পরিচয় দেন 'নিঃসন্তান ক্যাট লেডি' হিসেবে। কিছু সময় পর এর জবাব দিয়ে এক্সে পোস্ট দেন মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও টেসলার সিইও ইলন মাস্ক। তিনি লিখেন, 'ভালোই টেলর...তুমি জিতেছ...।'
দেড় ঘণ্টার বিতর্কে কমলা-ট্রাম্প কথার লড়াই চালান। যুক্তি উপস্থাপন, পাল্টাপাল্টি আক্রমণে একে অপরকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিতর্কে জিতলেন কে?
কয়েকজন বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজ বলছে, 'আজ রাতে, কমলা জিতেছেন।'
অন্যদিকে ভোটারদের মতামতের ভিত্তিতে ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, বিতর্কে এগিয়ে রয়েছেন কমলা।