বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে গ্যাস খাতে নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতি ও চুরি সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে দাম দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার পর শুধু চুরি ও অপচয়েই বছরে ক্ষতি হয়েছে ১০০ কোটি ডলার (১২ হাজার কোটি টাকা)। অন্যান্য খাত মিলিয়ে সর্বমোট লোকসানের পরিমাণ এর অন্তত ১০ গুণ বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস খাতের নানা দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন সময় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও তা দূর করার চেষ্টা কখনোই করা হয়নি। বরং সরকারি ও রাজনৈতিকভাবে এসব অপতৎপরতা আরও গতিশীল করা হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই খাতটির ভয়াবহ ভরাডুবি ঘটেছে। তাদের ভাষ্য, এই খাতটি ইতোমধ্যে কত বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত অন্তর্র্বর্তী সরকার টের পাবে। গ্যাস খাতের সংকট কাটিয়ে ওঠা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তারা।
পেট্রোবাংলার দেওয়া সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ৯ সেপ্টেম্বর বিজিএফসিএল'র আওতাধীন তিতাসের ২৬টি কূপের ক্যাপাসিটি ৫৪২ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও এদিন উৎপাদন ছিল ৩৭৭ মিলিয়ন ঘনফুট। হবিগঞ্জের ৮টি কূপের ক্যাপাসিটি ২২৫ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও উৎপাদন ছিল ১১৬.১ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ছাড়া বিবিয়ানার ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্যাপাসিটি ২৬টি কূপের উৎপাদন ছিল ১০০৬.৮ মিলিয়ন ঘনফুট। সব মিলিয়ে ১১৬টি কূপের মোট ক্ষমতা ৩ হাজার ৮২৯ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও ৯ সেপ্টেম্বর গ্যাস উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৬০৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এই হিসাবে সক্ষমতা অনুযায়ী, গ্যাস পাওয়া গেছে মাত্র ৬৮.১৩ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০-২০২৩ পর্যন্ত এই তিন বছরে গ্যাস খাতে গড়ে কারিগরি ক্ষতি (সিস্টেম লস) হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। গ্যাস সরবরাহে অপচয়ের পাশাপাশি চুরিও হয়। শিল্পেও চুরির গ্যাস ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে বেশি চুরি হয় আবাসিক খাতে। অথচ ৫ শতাংশ চুরি কমিয়ে শিল্পে সরবরাহ করা হলে চলমান গ্যাস সংকট কাটানো সম্ভব হতো।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের দাবি, আন্তর্জাতিকভাবে গ্যাস খাতে ২ থেকে ৩ শতাংশ অপচয় মানা হয়। বাংলাদেশের জন্য এটি বড়জোর ৫ শতাংশ হতে পারে। অথচ বছরের পর বছর সিস্টেম লস এর দ্বিগুণ দেখানো হচ্ছে। যা মূলত অর্ধেকই চুরি। সরকারি ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেট এর ফয়দা লুটেছে। যার দায় পুরোটাই শিল্প মালিকদের নিতে হয়েছে। গত দেড় দশকে শিল্পে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৬০ শতাংশ।
এদিকে দেশের স্থলভাগে ও সমুদ্রে পর্যাপ্ত গ্যাস থাকলেও তা অনুসন্ধান উত্তোলনে কার্যকর ভূমিকা না নিয়ে ব্যবসায়ী ও কমিশনভোগীদের স্বার্থে এই খাতকে আমদানিনির্ভর খাতে পরিণত করা হয়েছে। বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্যাস বিল দেওয়ার সময় সাধারণ জনগণের টাকায় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছিল। ওই উন্নয়ন তহবিলের টাকা দিয়েও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ করার সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি। বরং গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের টাকা গ্যাস আমদানিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
গ্যাস খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘ বিলম্বের পর সংকট কাটাতে দেশি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছিল বিগত সরকার। নতুন নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও পিছিয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ
বিভাগ গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে চার বছরে ৪৬টি কূপ খনন করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। এর মধ্যে প্রথম দুই বছর, অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যে ২১টি কূপ খননের কথা। যদিও হয়েছে মাত্র ৯টি। একই সময়ের মধ্যে নতুন কূপ থেকে জাতীয় গ্রিডে দিনে ২৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হওয়ার কথা। হয়েছে মাত্র আড়াই কোটি ঘনফুট, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯ শতাংশ।
স্থলভাগে গ্যাসকূপ খননের যখন এই অবস্থা, তখন সমুদ্রে আরও পিছিয়ে সরকার। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির এক যুগ পরও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন গতি নেই।
এদিকে স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বছর বছর কমছে। বিদেশ থেকে আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না মার্কিন ডলারের সংকটে। সব মিলিয়ে দেশে গ্যাস সংকট থাকছেই। ফলে শিল্পকারখানা যেমন ভুগছে, তেমনি রান্না ও পরিবহণে গ্যাস না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
বস্ত্র খাতের কারখানা মালিকরা জানান, শিল্প খাতে গ্যাস সংকট দীর্ঘদিনের। তবে সম্প্রতি তা আরও জোরাল হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা গেলে চাহিদা মোটামুটি পূরণ করা যায়। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুটের কম। এর মধ্যে ২০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হয় দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করে। বাকিটা আমদানি করা এলএনজি।
২০১৮ সালে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। যদিও আমদানিনির্ভরতার ঝুঁকি নিয়ে শুরু থেকেই সতর্ক করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা দেশেই উত্তোলন বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তবে সরকার আমদানিতে ঝোঁকে। কিন্তু মার্কিন ডলারের সংকটে পড়ে ২০২২ সালে এলএনজি আমদানি কমানো হয়। এরপর নতুন করে দেশি গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। বলা হয়, দ্রম্নত গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ৬টি ও ২০২৩ সালে ১৫টি কূপ খননের কথা। সবগুলো কূপ খনন হলে দিনে প্রায় ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়বে বলে তখন জানানো হয়েছিল, যা এখনকার সরবরাহের প্রায় ২৫ শতাংশের সমান।
জ্বালানি বিভাগের সূত্র জানিয়েছে, নির্ধারিত সময় খনন করা হয়েছে ৯টি কূপ খননের পাশাপাশি কাজ চলছে তিনটির। চলতি বছর ১৪টি ও ২০২৫ সালে ১১টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে নতুন করে আরও ১০০ কূপ খননের কথা বলছে জ্বালানি বিভাগ।
খনিজসম্পদ উত্তোলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত করপোরেশন পেট্রোবাংলা। তাদের অধীনে থাকা তিনটি কোম্পানি গ্যাস উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত- বাপেক্স, বিজিএফসিএল ও এসজিএফএল। এর মধ্যে একমাত্র বাপেক্সের কূপ খননের সক্ষমতা আছে। আর বাকি দুটি কোম্পানি ঠিকাদার নিয়োগ করে কাজ করায়।
পেট্রোবাংলা ও তিন কোম্পানির দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে যথাসময় কূপ খনন করতে না পারার কয়েকটি কারণ জানা গেছে। তারা বলছেন, চার বছরে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনাটিই বাস্তবসম্মত হয়নি। বছরে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিনটি কূপ খননের অভিজ্ঞতা আছে বাংলাদেশের। চাইলেই কম সময় বেশি কূপ খনন করা সম্ভব নয়। ফলে ২০২৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও বলছেন, কূপ খননে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদন করতেই লাগে এক বছরের বেশি। এরপর জমি অধিগ্রহণ ও যন্ত্রপাতি কিনতে লাগে কয়েক মাস। খনন শুরুর পর একটি অনুসন্ধান বা উন্নয়ন কূপ শেষ করতে লাগে অন্তত সাড়ে তিন মাস। আর সংস্কার কূপ খননে লাগে দুই মাস। কর্মকর্তারা বলছেন, মুখে অনেক কথা বলা যায়, পরিকল্পনা করা যায়। তবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। একই সময় একাধিক বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাতে পারলে বেশি কূপ খনন করা সম্ভব।
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, দীর্ঘদিন দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলার কারণে গ্যাসের বড় সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে সরকারের আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। এতে ব্যয় বাড়লেও দেশের জ্বালানি চাহিদা মিটছে না। দেরিতে হলেও অনুসন্ধান শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; এটা ইতিবাচক। যত দ্রম্নত অনুসন্ধানে গতি আসবে, ততো তাড়াতাড়ি জ্বালানি সংকট থেকে মুক্তি মিলবে।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও বঙ্গোপসাগরে এখনো অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ ভারত ও মিয়ানমার তাদের বস্নক থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস তুলছে। বাংলাদেশের অংশেও তেল-গ্যাস পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।