সারাদেশে ২০০২ সালে বিষাক্ত পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও তা আজও কার্যকর হয়নি। এখন সুপারশপে সীমিত আকারে পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা দেখার বিষয়। ক্ষুদ্র পরিসরের এ সিদ্ধান্ত বড় অর্জন হবে না বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। তারা পলিথিনের বিকল্প পাট ও কাপড়ের ব্যাগের সহজলভ্যতার দাবি করছেন। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের মূল্য ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে রাখার কথা বলছেন।
শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এগুলোর দ্বারা ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। অল্প বৃষ্টিতেই নগরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। একবার ব্যবহারের পর পলিথিনের ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। এসব পলিথিন খাল-বিল নালা হয়ে নদী ও সাগরে গিয়ে জমা হয়। সেখান থেকে জলজ প্রাণী তা গ্রহণ করছে। এসব প্রাণীর মাধ্যমে তা আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। ফলে দিন দিন তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে নিষিদ্ধ হচ্ছে ক্ষতিকর পলিথিন। রাজধানীর ৮৪ শতাংশ মানুষ বিষাক্ত পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। শহর ও গ্রামীণ জীবনে পলিথিনের ব্যবহার দিনের পর দিন বাড়ছে। দামে সস্তা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় পলিথিনের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বাজারের ব্যাগ থেকে শুরু করে গৃহস্থালিসহ নানা কাজে এবং বাণিজ্যিকভাবে পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিন বর্জ্য সহজে পচে না এবং এক হাজার বছর পরও মাটির সঙ্গে মিশে না। ফলে তা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সোমবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো পলিথিন শপিং
ব্যাগ ও পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা এর সম্মুখে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের ক্রয়ের জন্য রাখা হবে। এখানে তরুণ/শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা হবে। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ১ অক্টোবর'র শপিং ব্যাগের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার হবে। পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক সপ্তাহের মধ্যে সব সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, এসড্রর সঙ্গে মিলে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিকল্প পরিবেশবান্ধব উপাদানে তৈরি পাট ও বস্ত্রের ব্যাগের উৎপাদনকারীদের নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করবে। মেলায় সুপার শপের কর্তৃপক্ষ এবং উৎপাদনকারীরা নিজেদের চাহিদা এবং সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে।
এর আগে সরকার ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। সেই আইনে বলা হয়েছিল- যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা এমন কি উভয় দন্ড হতে পারে। বাংলাদেশ পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধকারী প্রথম দেশ হিসেবে সেই সময় বিশ্ববাসী বাংলাদেশের প্রশংসা করে। তবে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তখন পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের কথা বলা হলেও, সরকারের ২৫টি পাটকল বন্ধ রাখা হয়। ফলে পাটের সোনালি ব্যাগ বাজারে দেখা মেলেনি।
পরিবেশবিদ প্রকৌশলী সালাম মাহমুদ বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজার দুইশ' কারখানা রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। পুরান ঢাকার অলি-গলিতে রয়েছে প্রায় তিনশ' কারখানা। কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুলস্না পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক পলিথিন কারখানা। ঢাকা ও আশপাশের এলাকা ছাড়াও চট্টগ্রামসহ জেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে শত শত পলিথিন কারখানা। 'জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত' লেখা যানবাহনে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন।
পরিবেশবিদ ড. শংকর সাহা বলেন, পলিথিন তৈরির চেয়ে আরও ভয়াবহ ক্ষতিকর হচ্ছে পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে এর থেকে আবার নতুন পলিথিন বা পস্নাস্টিকসামগ্রী তৈরি করা। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া পুরনো পলিথিন বা পানির বোতল কুড়িয়ে এনে তা গলিয়ে আবারও বানানো হচ্ছে নতুন ব্যাগ। এতে পরিবেশ আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে ক্ষতিকর পলিথিন রিসাইক্লিং করার কোনো উদ্যোগ নেই। পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা বলা হলেও তা সহজলভ্য করা হয়নি। পাটের ব্যাগ এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা ইত্যাদি সহজলভ্য করতে হবে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশেষ টাস্কফোর্সকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক চিকিৎসক ডা. মাহতাব আখতার বলেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজারে পলিথিনের আধিপত্য এখন চরম পর্যায়ে। এমনকি পলিথিন ব্যাগে করে খাবার আনা-নেওয়া, হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে গরম খাবার বহন করা, ফ্রিজে পণ্য রাখতেও ব্যাপকভাবে পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ।
পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় ইথিন থেকে প্রাপ্ত পলিমারকে পলিথিন বলে। পরিবেশদূষণ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য পলিথিন মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। পলিথিন তৈরিতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশ সুরক্ষায় মোটেও উপযোগী নয়। পলিথিন এমন একটি পণ্য, যা মাটির সঙ্গে মিশতে আনুমানিক দেড় হাজার বছর সময় লাগে। পলিথিন অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় এর পরিত্যক্ত অংশ মাটির অভ্যন্তরে ঢুকে মাটির উর্বরতা হ্রাস ও মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। পলিথিন শুধু মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে তা-ই নয় বরং বিপন্ন করে তুলছে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকেও। অপচনশীল ও সর্বনাশা পলিথিনের এমন যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে চর্মরোগ, ড্যামেজ, লিভার অকেজো, বন্ধ্যাত্ব, ভ্রূণ নষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ুজনিত রোগ ও ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।