নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ার পরও ঢাকার অদূরে সাভারের শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় থামছে না শ্রমিক অসন্তোষ। সোমবারও নানা দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে ওই এলাকার ৭৯টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে মালিক কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা জোরদারের মাধ্যমে ইপিজেডসহ অন্য পোশাক কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে রোববার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে নানা দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে কমপক্ষে ৩০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ ও তৈরি পোশাক কারখানা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়ে সাভার ও ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানায় উপস্থিত হন শ্রমিকরা। তবে আশুলিয়ার জামগড়া, নরসিংহপুর, ইউনিকসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার শ্রমিকরা বেতন, হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ নানা দাবিতে কারখানায় কাজে যোগ না দিয়ে কারখানা থেকে বের হয়ে যান। এ ছাড়া শ্রমিকদের দাবি পূরণ করতে না পারায় আগে থেকেই অনেক কারখানার ফটকে কারখানা বন্ধ ও ছুটির নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়।
সকাল ৭টায় চার বছর ধরে বন্ধ থাকা ডিইপিজেডের ভেতরে দুটি তৈরি পোশাক কারখানা-লেনী ফ্যাশন ও লেনী অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা বকেয়া পাওনা পরিশোধের দাবিতে ডিইপিজেডের মূল ফটকের ভেতরের অংশে মানববন্ধন করেন।
মানববন্ধনে শ্রমিক মো. আজাদ বলেন, '২০২১ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে লেনী ফ্যাশন ও লেনী অ্যাপারেলস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই সময় কারখানা দুটির শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেপজার পক্ষ থেকে যে কোনো একটি কারখানা বিক্রি করতে পারলে বিক্রির সেই টাকা দিয়ে সবার বকেয়া পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ৬ মাস আগে একটি কারখানা ৮৩ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমাদের পাওনা ৬৬ কোটি টাকা।
\হবিক্রির টাকা ব্যাংকে জমা থাকলেও আমাদের দেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান চাই।'
এদিকে সকাল ৮টায় ধামরাই উপজেলার ইসলামপুর এলাকায় জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাটা শু ফ্যাক্টরির মূল ফটকের সামনে আরম্যাক সার্ভিসেস লিমিটেডের কর্মচারীরা বেতনবৈষম্য দূর করা, স্থায়ী শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি, স্থায়ী শ্রমিকদের ক্যানটিন ভাতা, আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ছাঁটাই না করাসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেন। পরে সকাল সাড়ে ১০টায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে শ্রমিকরা শান্ত হন।
সকাল সাড়ে ৯টায় আবদুলস্নাহপুর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত সড়কের শিমুলতলা এলাকায় হাজিরা বোনাস, গত মাসের বেতনসহ নানা দাবিতে ইউফোরিয়া অ্যাপারেলস লিমিটেড নামে একটি কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করেন। তখন সেনাবাহিনী ও শিল্প পুলিশের সদস্যরা তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেন।
শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, 'বেশকিছু এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে ৭৯টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'রোববার কয়েকটি পোশাক কারখানায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ফলে ৪৫টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।'
জানা যায়, রোববার আশুলিয়ায় আলিফ ভিলেজ লিমিটেড গ্রম্নপের তিনটি তৈরি পোশাক কারখানায় ব্যাপক হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। হামলাকারীদের অনেকে মুখোশ পরিহিত ছিল। দুপুরে আশুলিয়া ইউনিয়নের টঙ্গাবাড়ী এলাকার আলিফ ভিলেজ লিমিটেডের আলিফ এমব্রয়ডারি ভিলেজ লিমিটেড, লাম মিম অ্যাপারেলস লিমিটেড ও লাম মিম অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৪০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ছাড়া সন্ধ্যায় আশুলিয়ার শিমুলতলীতে ইউফোরিয়া নামে একটি কারখানায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। কারখানার কয়েকজন কর্মীকে তারা মারধর করেন। সেখানে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর র?্যাবের একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নির্মল চন্দ্র।
শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে গত কয়েক দিন নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। কারখানার মালিক, শ্রমিক নেতা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও হয় সমন্বয় সভা। পুরো আশুলিয়ায় নেওয়া হয়েছিল ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরপরও আশুলিয়া শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ থামানো যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সোমবার সকালে বেশ কয়েকটি কারখানায় যোগ দিয়ে এক পর্যায়ে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান শ্রমিকরা। কারখানার ভেতর তারা বিভিন্ন স্স্নোগান দিতে থাকেন। শ্রমিক নেতারা বলছেন, অন্যায্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা শ্রমিক নয়। কারা আন্দোলন করছে, তাদের খুঁজে বের করা দরকার। মালিকপক্ষ বলছে, যৌথ বাহিনীর বারবার আশ্বাস দিলেও পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।
পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকের চেয়ে পুরুষ বেশি নিয়োগ দিতে হবে- প্রধান এ দাবিসহ আরও কিছু দাবি নিয়ে ১০ দিন ধরে অসন্তোষ চলছে শিল্পাঞ্চলে। পোশাক কারখানায় পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। তবে গত কয়েক বছরে নারী শ্রমিকের হার অনেক কমেছে। গবেষণা সংস্থা ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) পরিসংখ্যান বলছে, পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের হার এখন ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এক সময় এ হার প্রায় ৮০ শতাংশ ছিল।
যৌথবাহিনী বারবার আশ্বাস দিলেও কেন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না- জানতে চাইলে বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, 'সমন্বয়ে বড় ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন বলতে এখন কিছুই নেই। আগে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশ ও শিল্প পুলিশকে কখনো আইনি, কখনো কৌশলগত ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। এখন সেটা একেবারেই নেই। শ্রমিক নেতাদের কথা শুনছে না আন্দোলনকারীরা। রাজনৈতিক বৈরিতাও তৈরি হয়েছে। মোটামুটি এসব কারণেই পরিস্থিতি আশানুরূপ উন্নতি হয়নি।'
শ্রমিক নেতাদের মধ্যে বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে পোশাক খাতে মজুরি ইসু্য ছাড়া অন্য কোনো ইসু্যতে আন্দোলন হয়নি। এখন মজুরির বাইরে নানা ইসু্য নিয়ে আন্দোলন প্রমাণ করে, এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। আবার কোনো কোনো কারখানায় কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। তার মতে, গত সাড়ে ১৫ বছর একপক্ষ কারখানা থেকে ঝুট, কাটপিস, স্টকলটসহ নানা দিক থেকে সুবিধা ভোগ করেছে। এখন নতুন পক্ষ তৈরি হয়েছে। দু'পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বেও শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব চলছে শ্রমিক আন্দোলনের নামে।'
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, 'সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়ে উৎপাদন শুরু করেন। তবে সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকেই কারখানার ভেতরে শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে যান। মূলত, দাবি নিয়ে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। তাই এমন ঘটনা ঘটছে। তবে মালিক পক্ষ দাবি নিয়ে শ্রমিকের সঙ্গে বৈঠক করলে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।'
অন্যদিকে, গাজীপুরের টঙ্গী?তে স?ঠিক সম?য়ে বেতন ও ১৩ দফা দা?বি? নি?য়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। গা?র্মেন্টস এক্স?পোর্ট ভি?লেজ লি?মি?টেডের দুটি কারখানার প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক সকাল ৮টা থেকে টঙ্গী পূর্ব থানার পেছ?নে কে?বিএম রো?ডের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
শ্রমিকরা জানান, গা?র্মেন্টস এক্স?পোর্ট ভি?লেজ লিমিটেডে দুটি কারখানা আছে। এক?টি মা টাওয়ারে আরেকটি আলম টাওয়ারে। এই দুই কারখানায় প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কাজ ক?রেন। কিন্তু আমরা আমাদের ন্যায্য কোনো কিছুই পাচ্ছি না। আমরা ১৩ দফা দাবি জানিয়েছি। না হলে কাজে ফিরব না।
আন্দোলনরত শ্রমিক আমেনা বেগম ব?লেন, 'আমরা আজও কর্মবির?তি দিয়ে কারখানার সাম?নে ব?সে আছি। আমা?দের ১৩ দফা দা?বি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কা?জে যোগদান কর?বে না। আমা?দের দাবি যখনই উপস্থাপন করা হয় তখন কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিক?দের সঙ্গে খারাপ আচরণ ক?রেন এবং চাক?রিচু্যত ক?রে দেন। কোনো ছু?টি চাই?লে ছু?টি পাওয়া যায় না। অসুস্থ? হ?য়ে পড়?লে স?ঠিক চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না।'
গাজীপুর শিল্প পু?লি?শের সি?নিয়র সহকা?রী পু?লিশ সুপার মোশারফ হো?সেন ব?লেন, 'শ্রমিক?দের দা?বি-দাওয়া নি?য়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আজও আলোচনা চল?ছে।'