বিশেষ সাক্ষাৎকার

নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক। দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে অসংখ্যবার কারা নির্যাতিত হাসনাত কাইয়ুম বাংলাদেশ জেলে ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা। হাওড় অঞ্চলের নদ-নদী-হাওড়-বাঁওড়-জল-জলা-বিল-প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার দাবিতে গড়ে ওঠা সংগঠন 'হাওড় অঞ্চলবাসী' এবং 'আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশন বাস্তবায়ন আন্দোলন' নামক পরিবেশবাদী নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মন্তোষ চক্রবর্তী

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
হাসনাত কাইয়ুম
যায়যায়দিন : আপনারা দীর্ঘদিন যাবৎ 'রাষ্ট্রচিন্তা' এবং পরে 'রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন' থেকে রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার পর এখন রাষ্ট্র সংস্কার টার্মটি জনসম্পৃক্ততা পেয়েছে। সংস্কারের রূপরেখা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে কি ভাবছেন? হাসনাত কাইয়ুম:প্রথমত একটা বিষয় বলা দরকার। আসলে আমরা রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন শুরু করারও আগে 'বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা' করেছিলাম এবং এ বিষয়ে ওই সময় প্রকাশনাও করেছিলাম। এই পর্যালোচনায় আমরা দেখেছিলাম, বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সমস্যা, সেই সমস্যাগুলোর মূলে আছে সাংবিধানিক ক্ষমতা কাঠামো, ফলে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হলে সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন এবং এই মতামত মানুষের মধ্যে প্রচারের পরে অনেকটাই গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া গিয়েছিল। তখন কাজটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, কারণ তখন পর্যন্ত অধিকাংশই ভাবত ৭২'র সংবিধান একটি পবিত্র সংবিধান বা খুবই গণতান্ত্রিক সংবিধান, পরবর্তীতে সংশোধনের কারণে সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে। তখন ৭২'র এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এক ধরনের আন্দোলনও ছিল। এমন একটা সময়ে আমরা বলেছিলাম যে, ৭২ সংবিধানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বীজটা। তখন এটা বোদ্ধা মহলে বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে। যারা আমাদের পুস্তিকা পড়েছেন কিংবা যারা এ বিশ্লেষণে ছিলেন কিংবা যাদের কাছে এই বিশ্লেষণ আমরা নিয়ে যেতে পেরেছি, যারা এই সাংবিধানিক সংকটকে সমাধানে একটি রাজনৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করেছেন- তাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আমরা প্রথমে 'রাষ্ট্রচিন্তা' নামের সংগঠন তৈরি করি। সেখান থেকে আমরা জার্নাল বের করি, সারাদেশে এই মতামতগুলো নিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলি, "কেমন বাংলাদেশ চাই", সেই বাংলাদেশে কীভাবে পৌঁছানো সম্ভব এই ধরনের আলোচনা নিয়ে রাষ্ট্রচিন্তা প্রথম থেকে জার্নালে, ওয়েব সাইটে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা মতামত গড়ে তোলার চেষ্টা করে। আমাদের দুটি পোস্টার খুব আলোচিত হয়েছিল। ২০১৮ সালে একটি পোস্টারে রাষ্ট্র মেরামতের ৭ দফা, আরেকটি পোস্টার করা হয়েছিল সেটাতে দেখানো হয়েছিল লাখো কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, সেই টাকাগুলো পাচার না হলে এই দেশটি কেমন হতে পারত। এই বিষয়গুলো মানুষের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। তাছাড়া ১৮'র কিশোর-তরুণদের নেতৃত্বে সড়ক আন্দোলনের সময়ে 'রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত' লেখা একটি পস্ন্যাকার্ড ভাইরাল হলে, আমাদের বক্তব্য আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। তখন সময়টা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। করোনার সময়ে শুধুমাত্র ত্রাণ বণ্টনে অসঙ্গতি হচ্ছে, সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে এটা তুলে ধরার অপরাধে রাষ্ট্রচিন্তার দিদারুল ভূইয়াকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গ্রেপ্তার করা হয়। দিদারুল কে বেশ কিছু দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে। আবার আমাদের উপরে মানুষের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দায় থেকে ২১ সালের আগস্ট মাসে ঘরোয়া পরিবেশে 'রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন' জন্ম নেয়। এরপর রাজপথে কীভাবে রাজনীতিতে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিকে কীভাবে এজেন্ডাভুক্ত করা যায়, সে লক্ষ্যে প্রথমে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে ঐক্য করার চেষ্টা এবং তারই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে 'গণতন্ত্র মঞ্চ' গড়ে উঠে এবং 'গণতন্ত্র মঞ্চ' রাষ্ট্র সংস্কারের রাজনীতিকে অনেকাংশে গ্রহণ করে। গণতন্ত্র মঞ্চই প্রথম 'সরকার এবং শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবিকে এক লাইনে বা এক দফায় নিয়ে আসে। পরবর্তীতে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের সবাই রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের দাবিকে নিজেদের রাজনীতির অঙ্গীভূত করে নেয়। ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা ছিলই আর ১৮ সালের কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে তাদের প্রতিটি আন্দোলনেই আমরা যুক্ত ছিলাম। সবার আগ্রহের কারণে আমরা ছোট সংগঠন হওয়ার পরও সবার মাঝে এই বোধটা তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল যে, এই রাষ্ট্র দিয়ে আর চলছে না, সে জন্যই প্রায় সবাই যার যার মতো করে হলেও রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছে। শেখ হাসিনা উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতির প্রথম এবং প্রধান এজেন্ডা হলো রাষ্ট্র সংস্কার। তার মানে, বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। আমরা মনে করি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এই দাবি সুপ্ত ছিল। আমরা তাদের মনের কথা বলতে পেরেছি, সেই দিক থেকে আমরা আনন্দিত। যায়যায়দিন : ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালে কোটা আন্দোলন, তারপর এক দফা তারপর সরকার পতন এই যাত্রাপথটা নিয়ে আপনার মতামত কি? হাসনাত কাইয়ুম : রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সাত দফা সংস্কার কর্মপরিকল্পনা ছিল যেমন- নির্বাচন ব্যবস্থা, সংসদ (আইন বিভাগ), প্রশাসন, বিচার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মানুষের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা। অন্তত এই ৭টি ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। এই সাত দফা দাবি যখন গণতন্ত্র মঞ্চে যায় তখন সেটিকে ১৪ দফা কর্মসূচি করা হয়। এতে ৭ দফা হচ্ছে- মৌলিক সংস্কারের আর ৭ দফা হচ্ছে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, কৃষিসহ জনগণের অধিকারভিত্তিক বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে ১৪ দফা করা হয়। পরবর্তীতে যখন বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করা হয় তখন এক দফা শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনটাই হচ্ছে মূল ব্যাপার। কারণ এটা স্পষ্ট ছিল যে, হাসিনার রেজিমকে পরিবর্তন করা না গেলে কোনো সংস্কারই করা সম্ভব না। মূলত আমরা এক দফা কর্মসূচির দিকে যখন যাই তখন ছিল ৫ দফা মিলে এক দফা। আমরা খুব সতর্ক ছিলাম, সাধারণভাবে এক দফা আন্দোলন যেমন হয় "এক দফা এক দাবি এরশাদ তুই কবে যাবি" সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ভাবছিলাম যে এ রকম এক দফা হলে, হাসিনা যাবে কিন্তু দেশের মানুষের কোনো লাভ হবে না। সে কারণেই এক দফার মধ্যে ৫ দফা দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করানো হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল- হাসিনার পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং রাষ্ট্রের সংস্কার। আমাদের পক্ষে দাবি ছিল রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে, গত নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এক দফা দাবিতে কর্মসূচি করেছিলাম কিন্তু তখন সেটা সফল হয়নি। বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতার কারণে কোনো দলের সঙ্গেই দলীয় লোক ছাড়া সর্বস্তরের জনগণকে মাঠে নামানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে সরকার বর্বর হত্যাকান্ড শুরু করার পর তাদের মৃতু্য সব মানুষকে মৃতু্যর স্পর্শ দিয়ে গেছে। মানুষেরা সন্তানদের হত্যাকান্ডকে মেনে নিতে পারেনি, একপর্যায়ে অভিভাবক যুক্ত হয়েছে, শ্রমিক, কৃষক, নারীসহ সাধারণ মানুষ যুক্ত হওয়ার কারণেই আন্দোলনটা অভু্যত্থানের রূপান্তরিত হয়। শেখ হাসিনাকে পালাতে হয়েছে। এর আগে এই দেশের ইতিহাসে এমন মর্মান্তিক ঘটনা আর কখনোই ঘটেনি, রেজিম পরিবর্তন করতে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হবে, নিজের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে, এমন ভয়াবহতার কথা মানুষ ভাবতেও পারেনি। যায়যায়দিন: বর্তমানে গেড়ে বসা স্বৈরতান্ত্রিক মডেলে 'রাষ্ট্র সংস্কার' কতটুকু ফাংশনাল হবে। কিংবা না হলে আপনাদের মতামত কি? হাসনাত কাইয়ুম: যদি ধরে নেই যে, এই মডেলটাই আছে, তাহলে বর্তমানে সবচাইতে জনপ্রিয় ছাত্রদেরকেও যদি সরকারে নির্বাচিত করা হয়, তারাও ব্যর্থ হবে। যেই উদ্দেশ্যে আন্দোলন করে ক্ষমতার পরিবর্তন করেছে সেটার বাস্তবায়ন হবে না। এখানে যে মডেল, এখানকার যে রাষ্ট্র কাঠামো, ক্ষমতা কাঠামো, এটা অব্যাহত রেখে জনগণের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। রাষ্ট্রের কাছে, বাংলাদেশের মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, যেই কারণে মানুষ ট্যাক্সের টাকা দিয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের পুষে, যে কারণে অফিস বানানো, যে কারণে সচিবালয় বানানো হয়েছে, যে কথা বলে বড় বড় প্রকল্প করা হয়েছে, বড় বড় স্থাপনা বানানো হয়েছে, যা কিছু হয়েছে, কোনোটাই জনগণের কাজ করবে না, কিংবা কোনোটাই জনগণের পক্ষে আসবে না, যদি রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা কাঠামোটাকে পরিবর্তন করা না যায়। অতএব এই মডেল অটুট থাকলে 'রাষ্ট্র সংস্কার' ফাংশনাল হবে না। আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে যদি সেটাকে পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই জনগণের পক্ষে আনা সম্ভব এবং এখনই সময়। যায়যায়দিন: আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। তাদের সরকার পতনের পর রাজনীতিতে একটা ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা তৈরি হয়েছে, এটার মোকাবিলা বা পরিস্থিতি উত্তরণ কীভাবে দেখেন? হাসনাত কাইয়ুম: আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল কিন্তু সে দল নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে, সে আর দল থাকল না, একটি সিন্ডিকেট হয়ে উঠল। আওয়ামী লীগে যে জনগণ ছিল, দলীয় সমর্থক ছিল, নেতারা বলা ভালো মালিকরা, সে জনগণের উপরে পুলিশকে বসিয়ে দিয়েছিল। এখানে আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজনের ভূমিকা ছিল না। পুলিশ বসিয়ে দিয়ে তাদের উপরে ৩০০টি আসনে তিনশ'টি পরিবারকে বসিয়েছিল এবং এই আওয়ামী লীগ নিজেদের দলটাকে খেয়ে ফেলল। যে এমপি হয়েছে, তার ভাই মেয়র হয়েছে, তার চাচা উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছে ভাইগ্নে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছে, তার শ্যালক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হয়েছে। এখানেও এক ধরনের পরিবারতন্ত্র তৈরি হয়েছে। দলের যারা নিবেদিত, যাদের পরিশ্রমে, যারা অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট এর বিপর্যয়ের পরেও টেনে টেনে দলটাকে ক্ষমতা পর্যন্ত নিয়ে আসছিল। এই আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে বেইমানি করে দলটাকে মাফিয়াদের হাতে তুলে দিয়েছিল শেখ হাসিনা তথা শেখ পরিবার। পাচারকারী, লুণ্ঠনকারীদের সিন্ডিকেটকে পাহারা দেওয়ার জন্য পিরামিড আকারে প্রশাসনের উপর থেকে নিচের দিকে কযেকশ' কর্মকর্তা, কিছু মিডিয়া হাউজ সব মিলিয়ে বড়জোড় দুই-আড়াই হাজার জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে লাখ লাখ মানুষের যে সংগঠন ছিল আওয়ামী লীগ সেটাকে ধ্বংস করে ফেলছে। ভ্যাকুয়াম আগেই তৈরি হয়েছিল, সিন্ডিকেটের লোকজন পালানোর কারণে এখন দৃশ্যমান হয়েছে। আমি এখনো কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না- একটা রাজনৈতিক দল, পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে নিজের দেশের মানুষকে কীভাবে খুন করে। এই ধরনের ইতিহাস তো আমাদের দেশে নাই। শুধুমাত্র শাসন ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এই ধরনের বর্বরতা কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারে না। আমাদের জন্য অনেক দুর্ভাগ্যজনক যে রাজনৈতিক দলের ভারসাম্য না থাকা, রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হওয়া, এজন্য বাংলাদেশের মানুষকে মূল্য দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যারা আজকে ক্ষমতায় আছেন বা পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসবেন তাদেরকে খুব সতর্ক থাকতে হবে; যেন এ রকম পরিস্থিতি তৈরি না হয় যাতে একদল একচেটিয়া ক্ষমতার মালিক হয়ে যায়। এখন যারা দায়িত্বে আছেন কিংবা আগামীতে যারা আসবেন তাদের কাজ হচ্ছে সমাজের ভেতরে বিরোধিতা করা ভিন্ন মত প্রকাশ করার অধিকারটা যেন মানুষ ভোগ করতে পারে। বিরোধিতা বা ভিন্নমত করলেই তাকে আওয়ামী কায়দায় শত্রম্ন বা নির্মূল করতে হবে এমন কালচার যেন তৈরি না হয়। তাহলে ৫৩ বছরের পরে, এত রক্তপাত করে যে সমাজ পুনর্গঠনের সম্ভাবনা বা রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেটা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে।এই ক্ষেত্রে সবাইকে সেটা রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। যায়যায়দিন: বর্তমান সরকারের কাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী রূপরেখা নিয়ে আপনার মতামত কি : \হ হাসনাত কাইয়ুম:এখনো তো নির্বাচনের ব্যাপারটা আসলে আসে নাই। আন্দোলনের পর রাজনৈতিক দল যেন একা ক্ষমতায় না বসে, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতার বসার আগে কিছু সর্বজনীন কাজ যেন করতে পারে তার জন্যই বর্তমান সরকারকে ডেকে এনে বসানো হয়েছে। বর্তমান সরকারের নিজের দলীয় কোনো এজেন্ডা নাই। তাদের নিজেদের কোনো দল নাই, দলীয় বাহিনীও নাই, মানুষের সমর্থন ছাড়া। প্রথমত এই সরকারকে সবার স্বার্থ রক্ষা করতে হবে এটাই হচ্ছে তাদের প্রথম দায়িত্ব। এই অভু্যত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা সেটি যেন কোনো একক দলের সম্পত্তি হয়ে না উঠে, সমস্ত দেশের মানুষ মিলেই পরিবর্তন এর কাজগুলো করা হচ্ছে এবং সবার প্রতিনিধি হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা বজায় থাকে, সরকারকে সেই দিকে সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী একটি দানব বাহিনীতে পরিণত হয়েছে এই বাহিনীকে সংস্কার করতে হবে। এই বাহিনী একদিক থেকে যেমন জঘন্য বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, অন্যদিকে প্রতিদিন মানুষের পুলিশের প্রয়োজন রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই সমস্ত কাজের সমন্বয় করতে হবে। আর সেটা যেন তারা সফলভাবে করতে পারে- সেজন্য বর্তমান সরকারকে সহায়তা করা উচিত। আবার নির্বাচন, সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, এই যে ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো, যেগুলোকে এক কেন্দ্রে আনার জন্য এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তির অধীনে আনার জন্য ধ্বংস করা হয়েছিল এগুলো যেন আর না হতে পারে সেজন্য, সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কার করতে হবে এবং সে কাজে বর্তমান সরকারকে সবার সহায়তা করতে হবে। যায়যায়দিন: আপনারা নতুন সংবিধান, না বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে সংস্কার চাইছেন? হাসনাত কাইয়ুম: প্রশ্নটা এভাবে উত্থাপন এবং এটাকে একটা তর্কের বিষয়ে পরিণত করার বিপক্ষে আমরা। এটা আমার কাছে কম প্রয়োজনীয় তর্ক। এসব তর্কের সহজ সমাধান হচ্ছে, সংবিধান সংস্কার বলি, নতুন বলি, পুনর্গঠন বলি, পুনঃলিখন বলি, যা কিছু বলি, তা বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু বাস্তবভিত্তিক কাজ আছে, সে কাজগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সেই কাজগুলোর মধ্যে দুই রকমের কাজ আছে, যেমন কিছু কাজ আছে পাঁচ বছর পরে করলেও সমস্যা হবে না, আবার কিছু কাজ আছে এক বছরের মধ্যে না হলে করা যাবে না। পরিবর্তনের সম্ভাবনাটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং সবচেয়ে বেশি ঐকমত্য আছে এমন কাজগুলোকে আমরা আগে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সম্পন্ন করার পক্ষে। যায়যায়দিন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়ে আপনাদের মতামত কি? হাসনাত কাইয়ুম: বর্তমান সরকারের মেয়াদের বিষয়ে আমার কাছে একটি সীমানা বিহীন তর্ক বলে মনে হয়। আমাদের জায়গা দেখে আমরা মনে করি এই সরকার কে কতগুলো কাজ করতে হবে। কতগুলো কাজ আছে একদম জরুরি। কতগুলো কাজ আছে এই সরকার করতে না পারলে পরবর্তী সরকার এসে করবে না। সরকার যদি কাজগুলো করতে শুরু করে এবং এই কাজের ভেতর দিয়ে বুঝতে পারবে কত দ্রম্নত সময়ে মধ্যে এই কাজগুলো করা সম্ভব। কিংবা আমরা সবাই মিলে তাদেরকে সহযোগিতা করলে কত সময় লাগবে। আমরা শুধু একটা কথাই বলতে চাই, বর্তমান সরকার জনগণের অনেক আকাঙ্ক্ষার সরকার। সরকার বিতর্কিত হওয়ার আগেই তাদের দায়িত্ব শেষ হওয়া উচিত। কোনোভাবেই সেই সরকার যেন বিতর্কিত হওয়ার পর্যায়ে না যায়। কেউ যেন বলতে না পারে, তারা দুইদিন বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার জন্য এই এই কায়দা করেছে, এমন অভিযোগ যেন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কেউ উঠাতে না পারে। কারণ এই সরকারের হাত দিয়ে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাতে হবে, এর জন্যই আমরা মনে করি প্রয়োজনীয় সময়টুকু মানুষ তাদেরকে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে, কিন্তু সে সময় তাদের ব্যয় করতে হবে মানুষের কাজে। যায়যায়দিন: ধন্যবাদ আপনাকে হাসনাত কাইয়ুম: আপনাকেও ধন্যবাদ।