'নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' অধীন নির্বাচনের পরামর্শ
আউয়াল কমিশনের পদত্যাগ
প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছে। পদত্যাগ ঘোষণার আগে 'বিদায়ী ব্রিফিং'-এ ভবিষ্যতের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছেন হাবিবুল আউয়াল। তার আরও পরামর্শ, এ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে হবে বিরতি দিয়ে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর বাকি থাকতেই আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবিধানিক পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ সময় দুই নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান ও সাবেক আমলা মো. আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে সিইসির সঙ্গে ছিলেন। নির্বাচন কমিশনার রাশদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান অনুপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। কমিশনের অন্য চার সদস্য হলেন-অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত জ্যৈষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক আমলা কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন এই কমিশন। হাবিবুল আউয়াল একসময় সরকারের আইন সচিব ছিলেন। পরে ধর্ম সচিব, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যৈষ্ঠ সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, পরিশেষে আপনাদের অবহিত করতে চাই, আমিসহ কমিশনাররা দেশের পরিবর্তিত বিরাজমান অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থির করেছি। আমরা আজই পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির সমীপে উপস্থাপনের নিমিত্তে পদত্যাগপত্রে সই করে সচিবের কাছে জমা দিয়েছি। ইতোমধ্যে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনারদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
বত্তব্যের শুরুতেই দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে বলেন, 'সেই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক
শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৯১-এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সূক্ষ্ণ বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, সেই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে মাত্র ২৭টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। সেসময় নিরাপদ প্রস্থানের (সেফ এক্সিট) বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে।
সিইসি বলেন, '২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে আসন পেয়েছিল মাত্র ছয়টি, পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি, মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান কমিশনের অধীনে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, '৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।' 'নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না'
নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না দাবি করে সিইসি বলেন, 'সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন কী কারণে কতদিনের জন্য স্থগিত করা যাবে- তাও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উলেস্নখ করা আছে। অতীতে কখনই কোনো কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেননি। সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে, দলের মধ্যে নয়। ২৯৯ আসনে ১৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বদ্বিতা করেছিলেন।
নির্বাচন নিষ্পন্ন করা অতিশয় কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ উলেস্নখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ বা দায়দায়িত্ব সবসময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে, কিন্তু সবসময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায়, আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সব নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বা সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচন সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছে। জাতীয় এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালট পেপার পাঠানো, কিছু উপ-নির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএম ব্যবহার, দেশের সব জেলায় একই দিনে, তবে প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে পাঁচ-ছয়টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল ইত্যাদি গৃহীত ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে। মধ্যে হয়নি, 'উইথিন হয়েছে... নট বিটুইন।'
তিনি আরও বলেন, কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দু'বছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি এবং সিটি করপোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, নিরপেক্ষতা অবাধ-হওয়া নিয়ে অতীতের মতো ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি। উপ-নির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে কমিশন নির্বাচন করছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি- এমন উদাহরণ নেই। সরকার বারবার বলেছে, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত।
সিইসি বলেন, 'কমিশনের সদস্যরা সংবিধান মেনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমাদের কর্মকালে আমরা গণমাধ্যম, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীসহ আবশ্যক সবার সহযোগিতা পেয়েছি। কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করছি।'
'বর্তমান ও অতীত থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাবনা সরকারের সদয় বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া কর্তব্য মনে করছি', উলেস্নখ্য করে সিইসি বলেন, 'বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার (হোমোজেনিটি) কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয় ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেইসঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি রেখে, অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচন পক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে উত্তম হবে। অধিকন্তু প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।'
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাত্রা শুরু করে। ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্র সংস্কারের আহ্বানের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে সরে যেতে হয় প্রধান বিচারপতিকে, পদ ছেড়ে দেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ আরও অনেকে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন। এবার সেই তালিকায় যোগ হলো হাবিবুল আউয়াল কমিশনের নাম।