সদ্যপতিত সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ সংসদ সদস্যসহ দেড় শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা, রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এদের কেউ কেউ ব্যাংক লুট, সরকারি-বেসরকারি জমি দখল ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের সঙ্গেও জড়িত। তাদের অধিকাংশের অপরাধ প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত প্রশাসনের হাতে রয়েছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ সংশ্লিষ্টদের অপরাধের ধারায় মামলা না করে খুনের মামলা দেওয়া হচ্ছে। এতে ওই অলিগার্করা সহজেই প্রকৃত অপরাধ থেকে পার পেয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
আইনজ্ঞদের ভাষ্য, লুটপাটকারীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দিয়ে তা যেমন আইন-আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব হয় না, তেমনি দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দিয়ে সাজা নিশ্চিত করা কঠিন। বরং এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রকৃত অপরাধ যে কোনোভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। তাই সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ, রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীরা প্রকৃতভাবে যে অপরাধে সম্পৃক্ত তার বিরুদ্ধে আইনের সেই সুনির্দিষ্ট ধারায় মামলা করা জরুরি।
এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের এক আইনজীবী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, আমলা ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ পাচার, লুটপাটের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ উলেস্নখ করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। এসব দুর্নীতি সংক্রান্ত ডকুমেন্টও প্রশাসনের হাতে থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। ফলে এসব অপরাধের নির্ধারিত ধারায় মামলা করা হলে দ্রম্নত সাজার আওতায় আনা সম্ভব। অথচ রহস্যজনক কারণে এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
যদিও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাবি, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানো হচ্ছে। গত ২০ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন সদ্যপতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিসহ ৪১ জনের দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ১৭ মন্ত্রী ও ৯ সংসদ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এর আগে ২৯ আগস্ট সাবেক ৯ মন্ত্রী ও ৫ সংসদ সদস্যের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
দুদকের দায়িত্বশীল
\হঅপর এক সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকা আরও অন্তত দেড়শ' সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তার দুর্নীতির ফাইল খুলতে যাচ্ছে কমিশন।
যদিও তাদের এ ধরনের তৎপরতা নিয়ে আইনজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের ভাষ্য, দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে তথ্য-উপাত্ত প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করতে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করে থাকে দুদক। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তারা নতুন পথে হাঁটছে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাই-বাছাই ছাড়াই অভিযুক্তদের দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সংস্থাটি। গত দুই সপ্তাহে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই ছাড়া শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক অন্তত ৫৬ জন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও মন্ত্রী পদমর্যাদার ১৮, প্রতিমন্ত্রী ও সমমর্যাদার ১৪ ও সাবেক সংসদ সদস্য রয়েছেন ২৪ জন।
এদিকে দুদকের সম্প্রতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'দুদক সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে। বাতাস দেখে চলা যাদের নীতি। কোনো একটি সরকার আসতে পারে, সেটা বুঝতে পেরে তাদের হয়ে কাজ করা। কোনো দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করতে হলে কিছু ম্যাটেরিয়াল ও মেরিট থাকতে হয়।'
'আমরা দেখেছি, এরা ক্ষমতাচু্যত ফ্যাসিস্ট সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়া সেটা আবার প্রত্যাহার করেছে; যেটার বিরুদ্ধে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই প্রতিবাদ করেছেন। আবার একজন বিএনপির নেতার মামলা তারা প্রত্যাহার করেছে।' কী কারণে কোন মামলা প্রত্যাহার করা হলো, সেটার ব্যাখ্যা থাকা জরুরি- যোগ করেন মইদুল ইসলাম।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের কার্যক্রম থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট বলে অভিযোগ করেন অনেকেই। তাদের ভাষ্য, স্বাধীন এই সংস্থাটির মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারে বিগত কোনো সরকারই গুরুত্ব দেয়নি। তাই দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অলিগার্কদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের দুর্নীতি নজরদারির জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা থাকার কথা দাবি করা হলেও তা যে অনেকটাই অন্তঃসারশূন্য তা সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভয়াবহ দুর্নীতির ফিরিস্তি ফাঁস হওয়ার পর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যদিও অনেকে মনে করেন রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে বিদ্যমান আইনি কাঠামো এবং ব্যবস্থা দিয়েই দুর্নীতির রাশ টানা সম্ভব। তাদের ভাষ্য, দুদক আছে। মন্ত্রণালয়গুলোয় নিজস্ব মনিটরিং সেল আছে। কিন্তু এগুলো অনেকটা কাগজে-কলমে। বাস্তবে এসব ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। রাষ্ট্রকাঠামোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু সেটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি আছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে সেটা নিরপেক্ষভাবে, আইনের চোখে সবাই সমান- এই মানদন্ডে কাজ করার মতো পরিবেশটা তৈরি হয়নি এখনো। অথবা যতটুকু পরিবেশ ছিল সেটাও নষ্ট হয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি যেসব মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতি তথ্য ফাঁস হয়েছে, এ তালিকায় রয়েছেন- সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক জ্বালানি খনিজসম্পদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক ত্রাণমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক সমাজ কল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমান।
সাবেক এমপিদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাকা-২০ বেনজির আহমেদ, কুষ্টিয়া-১ এ কে এম সারোয়ার জাহান, বগুড়া-২ শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, নাটোর-১ শহিদুল ইসলাম বকুল, যশোর-১ শেখ আফিল উদ্দিন, নাটোর-৩ ছলিম উদ্দিন তরফদার, যশোর-৩ কাজী নাবিল আহমেদ, রাজশাহী-৪ এনামুল হক, নোয়াখালী-৩ মামুনুর রশিদ কিরণ, খাগড়াছড়ি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, গাজীপুর-৫ মেহের আফরোজ চুমকি, ময়মনসিংহ-১১ কাজিম উদ্দিন, যশোর-৫ স্বপন ভট্টাচার্য, পটুয়াখালী-২ আনোয়ার হোসেন মন্জু, মাদারীপুর-১ নূরে আলম চৌধুরী, জয়পুরহাট-২ আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, বাগেরহাট-১ শেখ হেলাল উদ্দিন, ঢাকা-২ কামরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া-২ হাসানুল হক ইনু, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ জিয়াউল রহমান।
এ ছাড়া এস আলম গ্রম্নপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ও এমপি সালমান এফ রহমান, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া ও সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারসহ আরও ৬৩ জনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
উলিস্নখিত দুর্নীতিবাজদের একটি বড় অংশকে এরই মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত হত্যাকান্ডে দায়েরকৃত মামলায় আসামি করা হয়েছে। কাউকে কাউকে এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
তবে এভাবে গণহারে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তারের ধরন নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, এই সরকারকে মাথায় রাখতে হবে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের ফলে প্রতিবাদ থেকে এই সরকারের জন্ম। এই সরকারের কাছে মানুষ আইনের শাসনের পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রয়োগ প্রত্যাশা করে।
তিনি বলেন, 'আমরা বেশকিছু ক্ষেত্রে পুরনো অপশাসনেরই নতুন প্রয়োগ দেখতে পারছি। এটা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। আমরা চাইব আইনের শাসন ও মানবাধিকার যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হোক।'
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'গত সরকারের আমলে যারা অন্যায় করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এটা জনগণের দাবি। তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। ১৫ বছরে তিন ধারণের অপরাধ হয়েছে। এগুলো হলো- মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা (সহস্রাধিক ব্যক্তি খুন হয়েছেন) এবং ফৌজদারি অপরাধ। এ ছাড়া আর্থিক অপরাধ ও অর্থ পাচারের অপরাধ করেছে তারা। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে বিচার করে এসব অপরাধের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে।'
যেভাবে মামলাগুলো সাজানো হচ্ছে এতে সত্যিকারের অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে কি না সে ব্যাপারে অনেকের মনেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'ঢালাওভাবে মামলা দেওয়া হচ্ছে। সেই অতীতের সরকারের আমলেও একইভাবে মামলা হতো। একই সঙ্গে মামলাগুলোর সুস্পষ্ট অভিযোগের বিপরীতে অনেককে আসামি করা হচ্ছে। আমার মনে হয় না তারা সঠিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে। সঠিকভাবে মামলা রুজু করার ব্যাপারে বাদীকে আইনি সহায়তা করা দরকার।