হাজী সেলিম কারাগারে

সাবেক দুই আইজিপি ও দিলীপ কুমার আগরওয়াল রিমান্ডে

প্রকাশ | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
পৃথক হত্যা মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন ও শহীদুল হক এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মুদি দোকানি আবু সায়েদ হত্যা মামলায় চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুনের আট দিনের, রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় শহীদুল হকের সাত দিনের এবং বাড্ডা থানায় করা হৃদয় আহম্মেদ (১৬) হত্যা মামলায় দিলীপ কুমার আগরওয়ালার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। এ ছাড়া শিশু আলিফ অপহরণ মামলায় ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সুপারনিউমারারি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবদুলস্নাহিল কাফীর আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বুধবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এসব আদেশ দেন। আবু সায়েদ হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মামলায় চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা শক্ত হাতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মামলার আরেক আসামি ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। মামলার ৩ নম্বর আসামি চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুনসহ অন্যরা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মামলার ৫ নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান পুলিশকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করার নির্দেশ দেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচ করে জামিন চান তার আইনজীবী। আদালত শুনানি নিয়ে তার আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শহীদুল হকের রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়, নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে তাকে রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন। রিমান্ডের আবেদন নাকচ করে শহীদুল হকের জামিন চান তার আইনজীবী। শুনানিতে শহীদুল হক বলেন, তিনি কোনো হত্যার সঙ্গে জড়িত নন। তিনি নিরপরাধ। আদালত শুনানি নিয়ে তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সম্প্রতি শিশু আলিফ অপহরণের অভিযোগে রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। এই মামলায় আবদুলস্নাহিল কাফীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি নিয়ে তার আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন ও শহীদুল হককে গ্রেপ্তারের কথা মঙ্গলবার রাতে জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ থেকে বলা হয়, শহীদুল হককে উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদিকে চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন সেনা হেফাজতে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তিনি সেনা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাতে তাক পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এই সরকারে আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন। সরকার পতনের পরদিন তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। অন্যদিকে শহীদুল হক ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি অবসরে যান। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুলস্নাহিল কাফীকে গত সোমবার রাতে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করার কথা জানানো হয়। তখন অবশ্য বলা হয়েছিল, গত ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তা আবদুলস্নাহিল কাফীর সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিন দিনের রিমান্ডে দিলীপ এদিকে, রাজধানীর বাড্ডা থানায় করা হৃদয় আহম্মেদ (১৬) হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত বুধবার তাকে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন। এর আগে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে আদালতে হাজির করে বাড্ডার হৃদয় আহম্মেদ হত্যা মামলায় ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়, গত ১৯ জুলাই দুপুরে বাড্ডা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয় কিশোর হৃদয় আহম্মেদ। তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় হৃদয়। এই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এজাহারভুক্ত আসামি দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। অন্যদিকে দিলীপ কুমার আগরওয়ালার আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত দিলীপ কুমারকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে দিলীপ কুমারকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখা থেকে জানানো হয়। এর আগে মঙ্গলবার বিকালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এক বার্তায় জানায়, সোনা ও হীরা চোরাচালানের অভিযোগে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা ও হীরা আমদানির নামে অর্থ পাচার, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। সিআইডি বলেছে, অভিযোগ রয়েছে, দিলীপ কুমার প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন জেলায় নামমাত্র শোরুমের মাধ্যমে প্রকৃত ডায়মন্ডের বদলে উন্নত মানের কাচের টুকরাকে ডায়মন্ড বলে বিক্রি করেছেন। তিনি দুবাই ও সিঙ্গাপুরে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, ভারতের কলকাতায় তিনটি জুয়েলারি দোকান ও ১১টি বাড়ি এবং মালয়েশিয়া, দুবাই ও কানাডায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া নানাভাবে প্রতারণার মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অবৈধভাবে একটি ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার অভিযোগ পাওয়ায় সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট দিলীপ কুমার আগরওয়ালা এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে অনুসন্ধান শুরু করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-১ (আলমডাঙ্গা ও সদরের একাংশ) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য-বিষয়ক উপকমিটির সদস্য। রিমান্ডে অসুস্থ হাজী সেলিম পাঠানো হলো কারাগারে এদিকে, অসুস্থ হয়ে পড়ায় পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনের মাথায় সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। রিমান্ডফেরত প্রতিবেদন ও জেলহাজতে পাঠানোর আবেদনের শুনানি শেষে মহানগর হাকিম মো. আক্তারুজ্জামান বুধবার তাকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। রিমান্ডে 'অসুস্থ' হয়ে পড়ায় হাজী সেলিমকে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর বুধবার সকালে তাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডফেরত প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার এসআই আক্কাস মিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'উক্ত আসামির কাছ থেকে মামলার ঘটনার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। যাহা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গোপন রাখিয়া যাচাই-বাছাই করিয়া দেখা হইতেছে। উক্ত আসামি কথা বলতে পারে না এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাহার শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকায় এবং সে কথা বলতে না পারায় তাহাকে অতি গভীর ও নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয় নাই।' তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে আবার এও বলেছেন, 'আসামির ৫ দিনের পুলিশ রিমান্ড হইলেও তাহার শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকায় এবং সে কথা বলতে না পারায় তাকে রিমান্ডে রাখিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলেও কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয় বিধায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক তাহাকে আপাতত আর জিজ্ঞাসাবাদ না করিয়া জেলহাজতে আটক রাখা প্রয়োজন।' আদালতে লালবাগ থানার জিআরও (জেনারেল রেজিস্ট্রার অফিসার) মো. সেলিম খান বলেন, 'সকাল ৬টায় হাজী সেলিমকে বিধি অনুসারে সরকারি গাড়িতে করে আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। তবে তাকে আদালতের এজলাসে নেওয়া হয়নি।' হাজী সেলিমের আইনজীবী শ্রী প্রাণ নাথ বলেন, 'তাকে সংগোপনে সকাল ৬টায় আদালতে আনা হয়। এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানতাম না। রাত-দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এ খবর পেয়ে আমরা তার অসুস্থতার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট জেনারেল রেজিস্ট্রার বিভাগে যোগাযোগ করলে তারা জানান, তাকে সকালেই হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।' প্রাণ নাথ বলেন, 'আমরা জামিনের আবেদন করতে পারিনি। আদালত জামিন না দিলে যেহেতু তিনি সাবেক এমপি, তার প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পাওয়া এবং যেহেতু তিনি অসুস্থ, তার সুচিকিৎসার জন্য আমরা আবেদন করতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু আমরা খবর পাইনি, তাই এ ধরনের কোনো আবেদনই করতে পারিনি।' হাজী সেলিমের আইনজীবী বলেন, আজ (বুধবার) আমরা সংশ্লিষ্ট আদালতে জামিনের ও প্রথম শ্রেণির কয়েদির মর্যাদা চেয়ে তার চিকিৎসার আবেদন করব। যদি আদালত অনুমতি দেন, তাহলে আমরা এসব আবেদনের শুনানি করতে পারব।' লালবাগ আসনের সাবেক এমপি হাজী সেলিমকে গত রোববার রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে কলেজছাত্র খালিদ হাসান সাইফুলস্নাহকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। নিহত খালিদের বাবা কামরুল হাসান গত ১৯ আগস্ট লালবাগ থানায় এই মামলা দায়ের করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ৫১ জনকে তিনি আসামি করেছেন। সোমবার হাজী সেলিমকে আদালতে হাজির করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চাইলে ঢাকার হাকিম আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।