নারায়ণ চন্দ্র চন্দের আলাদীনের চেরাগ

প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
নারায়ণ চন্দ্র চন্দ
সাবেক মৎস্য প্রাণিসম্পদ ও ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের সম্পদ ও অর্থলাখ টাকা থেকে শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে-চিড়িং ও সাদা মাছের ঘের দখল, বাজার দখল, ঘরবাড়ি ও ভূমি দখল, চাঁদাবাজি, স্কুল-কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য এবং পুলিশে লোকবল নিয়োগের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নামে-বেনামে মাছের ঘের ও কৃষিজমি রয়েছে মাঠের পর মাঠ। খুলনার ডুমুরিয়ায় ও কলকাতার সল্টলেকে আলিশান বাড়ি রয়েছে। দামি গাড়ি-বাড়ি সবই আছে তার। শিক্ষক থেকে দুই দফায় মন্ত্রী হয়ে এখন তিনি শত কোটি টাকার মালিক। ডুমুরিয়া উপজেলার সাবেক মৎস্য কর্মকর্তা অনিল চন্দ্র বর্মণ বলেন, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর পশ্চিমাঞ্চলের আলোচিত সন্ত্রাসী মৃণাল কান্তি ও তার সহযোগী সুরঞ্জিত, গোপাল ও গাফফারকে পুনর্বাসিত করেন। সন্ত্রাসী মৃণাল ও তার সহযোগীদের নামে তখন শতাধিক মামলা থাকার কারণে তারা ভারতে আত্মগোপনে ছিল। এমপির সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে দেশে ফিরে তারা মন্ত্রীর ডানহাত হয়ে ওঠেন। মন্ত্রী তাদের দিয়ে প্রকাশ্যে মাছের ঘের দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাটসহ সন্ত্রাসী হিসেবে কাজ করেন। তখন থেকেই নারায়ণ চন্দ্র এলাকায় হয়ে ওঠেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনি ডুমুরিয়ায় দুর্নীতি, লুটপাটের এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। অভিযোগ রয়েছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী হওয়ার পর তার কপাল খুলে যায়। রাতারাতি হয়ে যান শত কোটি টাকার মালিক। স্থানীয় স্কুল-কলেজে নিয়োগে তার সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধম্যে ৫ থেকে ১২ লাখ টাকা ঘুষ নিতেন। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে চাকরির জন্য ২৪ লাখ টাকা ঘুষ নিতেন বলে এলাকায় প্রচলিত আছে। তিনি প্রায় ১০০ জনকে এভাবে চাকরি দিয়েছেন। তখন চাকরির জন্য ঘুষ নিতে পিছিয়ে ছিলেন না তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও মেয়ের জামাই। তারা সবাই চাকরি দেওয়ার নামে যে যেভাবে পেরেছেন টাকা নিয়েছেন। ডুমুরিয়ার হাসানপুর গ্রামের সেনাবাহিনীর সাবেক সার্জেন্ট সেলিম রেজা বলেন, '২০১৬ সালে আমার ছেলে সাব্বির খানের জন্য পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের পিএস বিপুল মন্ডলকে নগদ এক লাখ টাকা ও দুটি বস্ন্যাংক চেক প্রদান করি। তারপর বিপুল মন্ডল মন্ত্রীর কথা বলে ব্যাংকে একটি চেক দিয়ে আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা উত্তোলন করে। এখনো আমার ছেলের চাকরি হয়নি। বিষয়টি ডুমুরিয়া ইউপির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীরকে জানানো হয়। তিনি একটি সালিশ বৈঠক করেন। সেখানে বিপুল মন্ডল এক লাখ টাকা ফেরত দেন। আর বাকি টাকা দ্রম্নত টাকা ফেরত দেওয়ার কথা জানান। এর কিছুদিন পর বিপুল মন্ডল স্থানীয় রোকসানা বেগমের অন্য একটি চেক দিয়ে ১০ লাখ টাকা ওঠানোর চেষ্টা করে। যে ব্যাংকে আমার হিসাব, সেখানে না গিয়ে অন্য একটি ব্যাংকে গিয়ে ১০ লাখ টাকার চেকটি ডিজঅনার করে। তারপর রোকসানা ও বিপুল আমার কাছে ১০ লাখ টাকা চাচ্ছে। টাকা নিয়ে এখন উল্টো আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলাটি খুলনা জেলা জজ আদালতে চলমান রয়েছে।' স্থনীয় স্কুলশিক্ষক জামান সালেহ মোলস্না বলেন, স্থানীয় শত শত মানুষ টাকা দেওয়ার পর এখনো চাকরি পায়নি। তারা প্রায় প্রতিদিনই মন্ত্রীর বাসার সামনে অবস্থান নেন। চাকরি না দিতে পারায় চাকরি প্রার্থীরা মন্ত্রীর ছেলেমেয়ের কাছে হাটবাজারে প্রকাশ্যে টাকা চাচ্ছে। উৎসব-অনুষ্ঠানে গেলে সেখানেও চাকরি প্রার্থীরা তাদের টাকা ফেরত চাচ্ছে, এমন অবস্থায় মন্ত্রীর ছেলেমেয়ে একরকম বাসায় গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। এরপর তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বিষাক্ত হারপিক খেয়ে মারা যান। ২০২০ সালে মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের ছোট ছেলে খুলনা জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান অভিজিৎ চন্দ্র চন্দ হারপিক খেয়ে মারা যান। এর আগে মেয়ে জয়ন্তী রানী চন্দ বে?বি ২০১৭ সালে এভাবে মারা যান। স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ নিজের লোকদের টিআর-খাবিখার প্রকল্প দিতেন বলে অভিযোগ আছে। সেখান থেকে তিনি কমিশন নিতেন বলে জনশ্রম্নতি আছে। স্থানীয়ভাবে সরকারি সব নির্মাণকাজে তার নিজস্ব ইটভাটা ও বস্নকের প্রতিষ্ঠান থেকে এসব মালামাল নেওয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিল। অন্য কোনো ইটভাটার ইট দিয়ে কাজ করলে, সেই কাজ বন্ধ করে দিতেন মন্ত্রী বাহিনীর সদস্যরা। এলাকায় মন্ত্রী হয়ে ওঠেন এক অঘোষিত সিন্ডিকেটের গডফাদার। অভিযোগ আছে, অর্থের বিনিময়ে তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতা হমায়ুন কবীর ভুলুকে ডুমুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেন। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নাখোশ হন। স্থানীয় ব্যবসায়ী শংকর সাহা বলেন, কলকাতার সল্টলেকে দামি বাড়ি রয়েছে মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ্রের। ডুমুরিয়া বাজারেও নতুন আলিশান বাড়ি, বস্নক ও ইটভাটা কোম্পানি করেছেন। আছে নামে-বেনামে বহু সম্পদ। কলকাতার সল্টলেকে বাড়িতে থাকে তার মৃত মেয়ে বে?বির সন্তানরা। সেখানে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা জমাচ্ছেন মন্ত্রী পরিবার। এ ছাড়া ডুমুরিয়ার ব্যবসায়ী নির্মল ও মোবাইল ব্যবসায়ী শ্যামলের মাধম্যে কলকাতায় অর্থ পাঠানো হয় বলেও তিনি জানান। ডুমুরিয়া বাজারের বড় ব্যবসায়ী আরশাদ মোলস্না বলেন, সম্প্রতি মন্ত্রীর নামে স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর, সুরঞ্জিত ও লালনের ঘের লুটপাট করা হয়েছে। এরপর অনেকের ধানের জমি দখল করেছেন মন্ত্রীর লোকেরা। রহুল আমীনসহ অনেকের বাড়ি দখল করা হয়েছে। ডুমুরিয়া বাজারের বস্তি উচ্ছেদ করে বস্তির ভূমি দখল করেছে মন্ত্রীর লোকেরা। গোপাল, শিমুল, বকুল, মুকুলসহ অনেকের সাদা মাছ ও চিড়িংঘের দখল করে নানা ধরনের অপকর্ম করছে মন্ত্রীর লোকেরা। মন্ত্রীর সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট আলিয়া মাদ্রাসার পাশে সরকারি খাল দখল করে মাছ চাষ করছে। মন্ত্রীর নামে সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাছের ঘেরে নিয়মিত চাঁদাবাজি করছে। তিনি আরও জানান, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলায় মন্ত্রীর সন্ত্রাসী ক্যাডাররা তাদের ওপর মামলা-হামলা করে হয়রানি করে। এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে বৈধ দলিলপত্র থাকার পরও ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে এলাকা থেকে বিতারিত করে থাকে। এজন্য কেউ কথা বলতে সাহস করে না। স্থানীয় এক কলেজশিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ডুমুরিয়া মহিলা কলেজ, ডুমুরিয়া হাইস্কুল, ডুমুরিয়া আলীয়া মাদ্রাসা, চুকনগর ডিগ্রি কলেজ, ডুমুরিয়া পলস্নী শ্রী ডিগ্রি কলেজ, বান্দা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিজের লোকদের সভাপতি বানিয়ে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক, অধ্যক্ষ, কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। ডুমুরিয়া মহিলা কলেজে ভাইয়ের ছেলেকে চাকরি দিয়েছেন একইভাবে। এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানে ডুমুরিয়া বিএনপির সভাপতি মফিজ মোলস্নার ভাইয়ের বউকে চাকরি দিয়েছেন। এলাকায় তিনি বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে অনিয়মের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলেন। খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিছুদিন পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের মৃতু্য হলে তিনি এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর আওয়ামী সরকারের সর্বশেষ মন্ত্রিসভায় ভূমিমন্ত্রী দায়িত্ব পান নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। দুবার মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন। এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের মতামত নেওয়ার জন্য ডুমুরিয়ার বাড়িতে যাওয়ার পর তাকে বা তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে থাকা কাজের লোকরা জানায়, গত ৫ আগস্টের পর তারা বাড়ি থেকে চলে যান। এরপর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নিরাপত্তার জন্য পুরো পরিবার নিয়ে সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আত্মগোপনে রয়েছেন।