ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকে চেক নিয়ে ঘোরাঘুরি করেও চাহিদামতো টাকা তোলা যায়নি গত সপ্তাহের পুরোটা সময়, যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা।
অ্যাপ ও অনলাইনে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সীমিত করে রাখা এসব ব্যাংকে লেনদেন করতে না পেরে কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করেও গ্রাহকরা কোনো সমাধান পাননি।
আবার যেমন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক-এফএসআইবিতে টাকা তুলতে গেলে তাদের বলা হয়েছে, যার যে শাখায় অ্যাকাউন্ট, তাকে সেই শাখায় গিয়ে টাকা তুলতে হবে।
গত সপ্তাহের প্রথম কার্যাদিবস ছিল রোববার, ২৫ আগস্ট। সেদিন থেকে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অনেক গ্রাহক টাকা তুলতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির শিকার হওয়ার তথ্য দিয়েছেন।
মূলত এসব ব্যাংকের কাছে নগদ টাকা না থাকায় গ্রাহকদের এই ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে, যা স্বীকার করেছেন ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারাও। অবশ্য, তারা বলছেন, অচিরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
সাধারণ আমানত, মেয়াদি আমানত, বেতনের টাকা, সঞ্চয়- কোনো ধরনের হিসাব থেকেই চাহিদামতো টাকা তুলতে অথবা অনলাইনে অন্য ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়েও স্থানান্তর করতে পারেননি গ্রাহকরা।
গত সপ্তাহজুড়ে ব্যাংকগুলোর এমন কার্যকলাপে হতাশা ও আস্থাহীনতায় ভুগছেন গ্রাহকরা, যারা তাদের জমানো টাকার নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কায় পড়েছেন।
এমন একজন ভুক্তভোগী বেসরকারি চাকরিজীবী সাইদুর রহমান। গত সপ্তাহে ঢাকার মতিঝিলের দিলকুশায় এফএসআইবির শাখায় নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে চেক দিয়ে এক লাখ টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। ক্যাশ কাউন্টার থেকে তাকে বলা হয়, ২০ হাজার টাকার বেশি দিতে পারবে না।
কেন দিতে পারবেন না, সাইদুরের সেই প্রশ্নের জবাবে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে বলেন, নগদ টাকার সংকট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও তারা টাকা পাচ্ছেন না। তাই শাখার হাতে যে পরিমাণ টাকা আছে, তাই সবাইকে একটু একটু করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
হতাশ সাইদুর বাধ্য হয়েই ২০ হাজার টাকা নিয়ে ফিরে আসেন।
তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, 'আমার টাকা আমিই তুলতে পারছি না, এর চেয়ে হতাশার আর কিছু হয়! ব্যাংকের যে এই অবস্থা, অথবা কোনো সমস্যা, তা তো আগে থেকে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়নি। পুরো অবস্থাটা অদ্ভুত লেগেছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটির আরেকজন গ্রাহক কয়েকদিন ধরে অনলাইন লেনদেন করতে ব্যর্থ হয়ে গত সপ্তাহের বুধবার মহাখালী শাখায় তার স্যালারি অ্যাকাউন্ট থেকে বেতনের জমানোর টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তাকে পড়তে হয় অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার মুখে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, 'আমি ২০ হাজার টাকার কিছু বেশি টাকার চেক ক্যাশ কাউন্টারে দেই। তারা চেকটি ধরে কাজ করতে করতেই আমার দিকে না তাকিয়েই বলেন, হবে না। এখান থেকে আপনাকে টাকা দেওয়া যাবে না।
'কেন, কী হইছে? আমি জানতে চাইলে ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, আপনার অ্যাকাউন্ট খোলা যেখানে, সেখান থেকে টাকা তুলতে হবে, আমরা দিতে পারব না।'
এরপর কী হলো- জানতে চাইলে ওই গ্রাহক বলেন, 'আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, আমার অ্যাকাউন্ট যদি দিনাজপুর হয়, তাহলে আমাকে সেখানেই যেতে হবে? উত্তরে এলো- আমাদের কিছু করার নেই, আপনারটা আপনাকেই একটু ব্যবস্থা করে নিতে হবে।'
ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতার মুখে আগে কখনো পড়েছেন কিনা, জানতে চাইলে ওই গ্রাহক বলেন, 'মনে পড়ে না।'
তারল্য সংকট রয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গেস্নাবাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্শিয়াল ব্যাংকেরও। গ্রাহকরা গিয়ে চাহিদামতো টাকা না পেয়ে মুখ কালো করে ফিরছেন।
ক্ষমতার পালাবদলের পর ব্যাংক খাতের সংস্কারের কথা বলেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। 'দুর্বল' ব্যাংকগুলোর মালিকানায় ব্যাপক অনিয়ম, পরিচালনায় সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট হওয়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর সক্ষমতা তলানিতে এসে ঠেকেছে, যা নিয়ে দীর্ঘদিন করে কথা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের পছন্দের গভর্নরকে অপসারণ করে সেখানে বসানো হয় অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরকে। তিনি ব্যাংক খাতে সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন, তবে এর জন্য সময়ও চেয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আস্থাহীনতা বা শঙ্কা থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলে ব্যাংকগুলো যেন খালি করে না ফেলে এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু 'কৌশলগত' কারণে গ্রাহকের দিনপ্রতি সর্বোচ্চ টাকা তোলার সীমা বেঁধে দিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ দেশের ব্যাংকিং খাত সচল রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত সপ্তাহে দিনপ্রতি ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সীমা ছিল চার লাখ। অথচ শরিয়াভিত্তিক 'দুর্বল' ও 'রেড জোন'ভুক্ত ব্যাংকগুলো দিতে পেরেছে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। আবার কোনো কোনো শাখায় ৩০ হাজার টাকার চেক নিয়ে গেলে ১০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, 'আপাতত চলুন, আগামী সপ্তাহ থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে।'
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা নগদ তুলতে পেরেছেন বলে তথ্য রয়েছে। ব্যাংকটির দিলকুশা প্রিন্সিপাল শাখায় থেকে কিছু কিছু গ্রাহক তাদের চাহিদা মোতাবেক টাকা পেয়েছেন, যদিও তা চার লাখ টাকার নিচে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে দুইজন সেনা কর্মকর্তা এক লাখ টাকার চেক নিয়ে এলে তাদের টাকা দিয়ে দেওয়া হয়।
ব্যাংকটির দিলকুশার প্রিন্সিপাল শাখার ম্যানেজার মো. মোতালেস্নবের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে? জবাবে তিনি বলেন, 'তারল্য সংকট রয়েছে। তাই আমরা গ্রাহকের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে পারছি না। আগামী সপ্তাহে এই সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।'
ইউনিয়ন, গেস্নাবাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্শিয়াল ব্যাংকেও একই অবস্থা। ২০-৩০ হাজার টাকার বেশি নগদ দিতে পারছে না তারা।
চলতি বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ব্যাংক খাতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে; ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যার যাত্রা শুরু।
চরম অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতের মাধ্যমে ব্যাংকটি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের হয়ে যাওয়ায় এটি 'দুর্বল' হিসেবে চিহ্নিত হয়। যে কারণে পরিচালনা পর্ষদ বোর্ড পুনর্গঠনসহ ব্যাংকিং পরিচালনা নীতিতেও পরিবর্তন চাচ্ছেন ইসলামী ব্যাংকের পুরনো কর্মকর্তারা।
পরিবর্তনের ধারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, সঙ্গে দুই ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউর প্রধান ও পলিসি উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন বা তাদের অপসারণ করা হয়।
গভর্নরের দায়িত্বে বসে আহসান মনসুর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, 'অবৈধভাবে কোনো দুর্বল ব্যাংককে আর তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকেও তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। কারণ, এটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না।'
মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক গত দুই বছর ধরে এস আলমের দখলে থাকা ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিয়ে আসছিল, টাকা ছাপিয়েও তাদের দেওয়া হয়েছে বলে খবর রয়েছে। তবে 'তলাফুটো' ব্যাংকগুলো এতেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
এমন কি এসব ব্যাংক আমানতের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ টাকা রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছিল বলে খবর রয়েছে। গভর্নর আহসান মনসুর তার কয়েকটি সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় তুলে ধরে ব্যাংক খাতের সংস্কারে উদ্যোগী হওয়ার কথা বলেছেন।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে এসব ব্যাংক বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো রকম তারল্য সহায়তা পাচ্ছে না। তাই গ্রাহকরা তাদের জমানো টাকা ফেরত চাইলেও তা প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে পারছে না ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো।
এ বিষয়ে একজন সাধারণ গ্রাহক হিসাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও অপারেশন ম্যানেজার শফিকুল আলমকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন ২০ হাজার টাকার বেশি টাকা উত্তোলন করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, 'ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে। এটা শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক এত দিন তারল্য সহায়তা দিয়ে আসছিল। সেটা বর্তমানে বন্ধ আছে।'
যদিও এভাবে তারল্য সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি সঠিক ছিল না বলে মনে করেন ব্যাংক কর্মকর্তা শফিকুল।
নাম প্রকাশে অনাগ্রহী বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'এসব ব্যাংক এভাবে তারল্য সহায়তা পেয়েছে, কারণ সাবেক গভর্নর অনুমোদন দিয়েছিলেন তাই। কিন্তু তা ঠিক ছিল না।'
তিনি বলেন, 'এসব শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রম্নপ নানা সময় ঋণ নিয়ে আর ফেরত না দেওয়ায় তাদের অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে।'
অবশ্য, নগদ টাকা লেনদেনে ইসলামী ব্যাংকে কোনো সমস্যা ছিল না বলে জানা গেছে। সূত্র : বিডিনিউজ