অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান বুধবার শুরু

উদ্ধার হওয়া অবৈধ অস্ত্র -বিডিনিউজ

প্রকাশ | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সদ্য গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে আন্দোলনের সময় থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গুলির একটি বড় অংশ এখনো দুর্বৃত্তদের হাতে রয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গণহারে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ায় পলিটিক্যাল ক্যাডার ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এ সুযোগ নিয়ে বৈধ অস্ত্র কিনেছে। যা পরবর্তীতে তারা খুন, চাঁদাবাজি, ভূমি দখলসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ব্যবহার করেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে এসব বৈধ অস্ত্র দিয়ে অবৈধভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী আহত ও নিহত হলেও ওইসব পলিটিক্যাল আর্মস ক্যাডাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেওয়া অস্ত্রের লাইসেন্সও স্থগিত করে সেগুলো থানায় জমা দেওয়ার জন্য ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় সরকার। তবে এরপরও এসব অস্ত্র খুব বেশি জমা পড়েনি। তাই আগামী ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যৌথবাহিনী সমন্বিতভাবে এই বিশেষ অভিযান চালাবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এ কথা জানিয়েছেন। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক বার্তায় বলা হয়, ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে। এর আগে গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। ওই সময়ে পর্যন্ত যাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তাদের আগামী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র-সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা দেওয়ার শেষ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দেশে এখন বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কমবেশি ৫০ হাজার। এর মধ্যে ১০ হাজারের বেশি অস্ত্র রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে। তাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। যাদের অনেকেই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের সময়ে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, 'নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব অস্ত্র জমা দিতে হবে। এরপর কারও কাছে কোনো অস্ত্র থাকলে সেটা অবৈধ বলে গণ্য হবে।' অভিযানে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হবে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তারা যেহেতু বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য মাঠে আছে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিযানে তাদেরও সহযোগিতা নেওয়া হবে। থানা-ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করা হবে। তাছাড়া দাগি অপরাধী ও ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।' পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, 'আন্দোলনের সময় দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের লোকজনও বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। তারাও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে। আমরাও তথ্য পেয়েছি গত ১৫ বছরে এক লাখের বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।' এদিকে বৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার ঘোষণায় শিল্পপতি, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে অস্বস্তি। অনেকে নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কা দেখছেন। কারণ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে সরকার পতনের দিন অনেক থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্ত হয়েছে। ভস্মীভূত ও ধ্বংস হয়েছে পুলিশের অনেক স্থাপনা। পুরো সক্ষমতায় ফেরেনি পুলিশ। চালু হয়নি পুলিশের টহল ও তলস্নাশি কার্যক্রম। নেই সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ ও দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারের সাঁড়াশি অভিযান। এ পরিস্থিতিতে তাদের বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থানায় জমা দিলে তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, শঙ্কার কোনো কারণ নেই। পুলিশের সক্ষমতা ফিরে এসেছে। বৈধ-অবৈধ ও থানা-ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত সব ধরনের অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান বা সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় যৌথ অভিযান শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সারাদেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি। এগুলোর মধ্যে পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩টি, রিভলবার ২ হাজার ৪৩টি, একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, দোনলা বন্দুক ১০ হাজার ৭১৯টি, শটগান ৫ হাজার ৪৪৪টি, রাইফেল ১ হাজার ৭০৬টি এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪ হাজার ৬টি। বাকি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা। প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এসব অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের কাছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) রেজাউল করিম বলেন, 'কেন এসব লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে সেটার কারণ প্রজ্ঞাপনেই বলা আছে। আমার মতে এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। এরপরও কেউ নিজেদের অনিরাপদ মনে করলে পুলিশের পাশাপাশি ব্যাটালিয়ন আনসারের সহযোগিতা নিতে পারেন।' গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এক ঘোষণায় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে। একই সঙ্গে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বৈধ লাইসেন্স গ্রহীতার স্থায়ী ঠিকানার থানায় অথবা বর্তমান বসবাসের ঠিকানার থানায় নিজে বা মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে জমা দিতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে 'যাদের আগ্নেয়াস্ত্র থানা, জেলা ট্রেজারি ও আর্মস ডিলারদের কাছে জমা রাখা আছে; তাদের ক্ষেত্রে অস্ত্র জমাদানের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না।' অংশটি সংযুক্ত করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত ও জমা দেওয়ার নির্দেশের পর অনেকেই সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করছেন। কীভাবে অস্ত্র জমা দেবেন, সে বিষয়ে জানতে চাইছেন। অনেক থানার নথিপুড়ে যাওয়ায় অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজধানীর মিরপুর মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, 'অগ্নিসংযোগের কারণে আমাদের থানাভবন সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এজন্য মিরপুর এলাকার বৈধ অস্ত্র ব্যবহারকারীদের কাফরুল থানায় অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। এছাড়া থানার নথি পুড়ে যাওয়ায় মিরপুর থানা এলাকায় লাইসেন্সপ্রাপ্তদের তথ্য আমাদের কাছে নেই। এই তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।' কাফরুল থানার ওসি কাজী গোলাম মোস্তফা বলেন, 'যেকোনো সময়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে অস্ত্র জমা দেওয়া যাবে বলে বৈধ অস্ত্র গ্রহীতাদের জানানো হয়েছে।' ভাটারা থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের থানা আক্রান্ত হয়ে অনেক নথি ধ্বংস করা হয়েছে। অস্ত্র জমা দিতে অনেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমরা শুরুতে নিতে পারেনি। তবে পরে অস্ত্র জমা নেওয়ার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়েছে।' এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের। ওই সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে ১ হাজার ৮৯৮টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে। খোয়া যাওয়া বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের মধ্যে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪৫৩টি উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৪৪৫ অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৩৪৮টি চায়না রাইফেল, শটগান ৭০৩টি, ৩০টি এসএমজি (টি ৫৬ চায়না মডেল), ১৩টি এলএমজি, ৮৯টি পিস্তল (টি-৫৪ চায়না), ৫৬০টি পিস্তল, ১৫২টি গ্যাসগান ও ৩টি টিয়ার গ্যাস লাঞ্চার।