আশ্রয়ের খোঁজে দুর্নীতিবাজরা

প্রকাশ | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
সদ্যপতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রশাসন ও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা লুটেরারা এখন নয়া আশ্রয়দাতার খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কিংবা অবৈধ সম্পদের ছোটখাটো অংশ 'ভ্যাট' দিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করার মিশনে নেমেছেন তারা। কেউ কেউ আবার বর্তমানে ক্ষমতার বলয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের শেল্টার নিয়ে নিজের অবৈধ সম্পদ রক্ষার চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকেই এ ব্যাপারে দফা-রফাও করে ফেলেছেন। ফলে ১৫ বছরে নানা অপকৌশলে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যাওয়া দুর্নীতির মূল কারিগররা বরাবরের মতো এবারও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পটপরিবর্তনের পর পতিত সরকারের লুটেরাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের ভূমিকা নেওয়ার বিষয়টি দেশের রাজনীতিতে অলিখিত রীতিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই এ ধারা চলমান। তবে গণ-অভু্যত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করায় এবারের প্রেক্ষাপট অনেকটা ভিন্ন হবে এমনটা আশা করেছিলেন অনেকেই। যদিও বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। বরং বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার পতিত সরকারের লুটপাটকারীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ঘটনা আরও বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি সেক্টরে নতুন করে চাঁদাবাজি, দখল-বাণিজ্য এবং টেন্ডার ভাগাভাগির মহোৎসব শুরু হয়েছে। পাঁয়তারা চলছে ক্ষমতা ভাগাভাগির। পতিত সরকারের সর্বস্তরে বৈষম্য, দুঃশাসন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে তাদের ক্ষমতাচু্যত করতে ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছে। অথচ আওয়ামী দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার পর ওই সময়ের চিহ্নিত চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজদের কেউ না কেউ কোনো না কোনো শর্তে নতুন করে আশ্রয় দিচ্ছে। দলীয় হাই কমান্ড এ ব্যাপারে নেতাকর্মীকে বারবার সতর্ক করলেও ব্যক্তি স্বার্থে তারা এসবের থোড়াই কেয়ার করছে। ফলে পুরনো দুর্নীতিবাজরা বিভিন্ন সেক্টরে ফের নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে বিগত সরকারের আমলে যারা অনিয়ম-দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত, তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মুখোশ পাল্টে তারা নতুন করে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সঙ্গে আঁতাত করছে। কীভাবে রাতারাতি অবৈধ টাকা কামিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়া যাবে তার ছবক দিয়ে প্রভাবশালীদের দ্রম্নত দলে ভেড়াচ্ছে। ফলে স্বৈরাচার সরকারের ১৫ বছরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের সম্পদ আগলে রাখতে মরিয়া নব্য ক্ষমতাধররা। এতে দেশকে দুর্নীতি ও দখলমুক্ত করতে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ বিফলে যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আর্থিক গোয়েন্দাদের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সদ্যপতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক লুট, নানা খাতে দুর্নীতি ও দখলবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক বনে যাওয়া বেশ কয়েক রাঘব-বোয়ালকে তারা নজরদারিতে রেখেছেন। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ দেশেই আত্মগোপনে আছেন। অথচ দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী তাদের 'উদ্ধার কর্তা' হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। তারা তাদের ফেলে যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, রিসোর্টসহ বিভিন্ন ভূ-সম্পত্তি আগলে রাখতে নানা ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছেন। এদের অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার বলে নিজেকে জাহির করে প্রকৃত সত্য গোপন করছেন। এদিকে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আঁতাত করে তাদের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা সরিয়ে দেওয়ার জন্য নব্য ধান্ধাবাজরা নানা ফন্দি আঁটছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, দুর্নীতিবাজদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অংকের টাকা তুলতে গেলে যদি আটকে দেওয়া হয় এমন আশঙ্কায় কেউ কেউ তাদের আশ্রয়দাতাদের নামে 'ব্যাক ডেটের' অ্যাকাউন্টপেয়ী চেক ইসু্য করছেন। একই সঙ্গে তারা চেকে উলিস্নখিত টাকার সমপরিমাণ বকেয়া ব্যবসায়িক লেনদেনের ডকুমেন্ট তৈরি করে রাখছেন। যাতে চেক ইনক্যাশ (নগদায়ন) করার সময় প্রশাসনিক বা আইনগত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তারা এসব ডকুমেন্ট প্রদর্শন করতে পারেন। এ ছাড়া এসব ডকুমেন্ট দেখিয়ে আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজদের শেল্টার দেওয়ার দলীয় অপবাদ ঠেকানোরও অপচেষ্টা চলছে। অন্যদিকে বিগত সরকারের আমলে অবৈধ ক্ষমতার অপব্যবহার, জাল-জালিয়াতি ও নানা ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠা মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা, দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা এখনো দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি, তারা নানা ধরনের আর্থিক কিংবা ব্যবসায়িক সুবিধার বিনিময়ে বর্তমান ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা রাজনীতিকদের শেল্টার খুঁজে নিচ্ছেন। এমনকি কেউ কেউ তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে লুকিয়ে থাকার কিংবা বিশেষ ব্যবস্থায় চোরাপথে প্রতিবেশী দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। পাশাপাশি এসব দুর্নীতিবাজের সম্পদ পাহারায় দলীয় নেতাকর্মীকে নিয়ে অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে উঠেছেন। সদ্যপতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের শেল্টার দেওয়ার বিষয়টি বিএনপি হাইকমান্ড মুখে স্বীকার না করলেও এ ধরনের অপতৎপরতায় মাঠে নামার অভিযোগে দলের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে দলীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি হাজী সেলিম ও তার ছেলে সোলায়মান সেলিমকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মোশাররফ হোসেন খোকনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ দপ্তরের চলতি দায়িত্বে থাকা সাইদুর রহমান মিন্টু স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানোর নোটিশ গত ১৯ আগস্ট খোকনকে পাঠানো হয়। যদিও বিষয়টি প্রথমদিকে গোপন থাকলে পরে তা বিভিন্ন মহলে জানাজানি হয়। এতে বলা হয়, 'যেহেতু আপনার বিরুদ্ধে পতিত স্বৈরাচার, ছাত্র-জনতার খুনি হাসিনার অপকর্মের সহযোগী, অসংখ্য চাঁদাবাজি, হত্যা, বিএনপিদলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সাবেক এমপি হাজী সেলিম ও তার ছেলে বিনাভোটের সংসদ সোলায়মান সেলিমকে আশ্রয়, প্রশ্রয় এবং পুনর্বাসন চেষ্টা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।' 'যেহেতু উপরোক্ত অভিযোগ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল। সেহেতু আপনার বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, এই মর্মে পত্র প্রাপ্তির তিনদিনের মধ্যে সশরীরে লিখিতভাবে দলীয় কার্যালয়ে এসে জবাব দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়ে আপনাকে অবগত করা হলো।' বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, ওই নোটিশের কোনো লিখিত জবাব দেননি অভিযুক্ত মোশাররফ হোসেন খোকন। আর দল থেকেও পরবর্তী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাভোগী বসুন্ধরা গ্রম্নপের চেয়ারম্যান ও এমডিকে বাঁচাতে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক কাদের গণি চৌধুরী দায়িত্ব নিয়েছেন- এমন খবরে খোদ দলের ভেতরেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। পাশাপাশি এ নিয়ে দলে ব্যাপক অসন্তোষও দেখা দেওয়ায় বিএনপি হাইকমান্ড এরই মধ্যে দলের মিডিয়া সেলের সদস্যের পদ থেকে কাদের গণিকে অব্যাহতি দিয়েছে। এদিকে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর (সওজ) সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিদপ্তরে কর্মরত আওয়ামীপন্থি প্রকৌশলীরা মুহূর্তের মধ্যে তাদের চরিত্র পাল্টে ফেলেছে। বিশেষ করে অধিদপ্তরে যেসব প্রকৌশলী দুর্নীতির হোতা এবং অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে, তারা বাঁচার জন্য বিএনপির নামধারী নেতাদের সঙ্গে আঁতাত শুরু করেছেন। কীভাবে ওইসব নেতার অন্যায় আশ্রয়ে নতুনভাবে দুর্নীতি করা যায়, তার পাঁয়তারা করছেন। তারা শক্তভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে মহড়া দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মহানগর উত্তরের এক প্রভাবশালী নেতা তাকে অধিদপ্তরের বড় বড় ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি ফুলে ফেঁপে ওঠা প্রকৌশলীসহ অন্য কর্মকর্তাদের শেল্টার দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। অন্যদিকে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে গেছে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিস্নউটিএ) ভেতরকার চিত্র। আওয়ামী লীগপন্থি সিবিএ নেতা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সব সিবিএ নেতাই গা-ঢাকা দিয়েছেন। তারা অনেকে এখন অফিসে আসেন না; কেউ কেউ বাসাবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের ঘাড়ে ভর করে যেসব কর্মকর্তা ঢালাওভাবে দুর্নীতি করেছেন, তারা এখন বিএনপিপন্থি সিবিএ নেতাদের শেল্টার নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে এ মিশন সফল করেছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠা কয়েক ব্যক্তি এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ নেতা ও ঠিকাদারদের শেল্টার দিয়ে তার বিনিময়ে ঘাট ইজারা, উন্নয়ন কার্যক্রম ও জনবল নিয়োগে অনিয়ম এবং বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার হাতিয়ে নেওয়ার অপতৎপরতায় আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, শুধু সড়ক জনপথ কিংবা বিআইডবিস্নউটিএই নয়, গণপূর্ত অধিদপ্তর, বিদু্যৎ সেক্টর, এলজিইডি, ওয়াসা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ প্রায় সব দপ্তরেই চলছে বিগত আমলের দুর্নীতিবাজদের শেল্টার দিয়ে বিশেষ সুবিধা আদায়ের প্রতিযোগিতা।