লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ঘিরে জনমনে আতঙ্ক

প্রকাশ | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিতে বার বার সময় বাড়ানো হলেও আশানুরূপ সাড়া না মেলায় জনমনে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বন্যাসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সময়সীমা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার বার সময় দেওয়ার পরও আশাতীত ফলাফল না পাওয়ায় লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেশাদার অপরাধীদের হাতে চলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হওয়া বিচিত্র নয়। তাই লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে সরকারের উচিত দ্রম্নত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপরই সারাদেশের বহু থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বন্ধ হয়ে যায় দেশের ৬৩৯টি থানার কার্যক্রম। টানা ১০ দিন চেষ্টার পর সব থানার কার্যক্রম চালু হয়। পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রকৃতপক্ষে কি পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ লুটপাট বা খোয়া গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে ঘটনার পরপরই পুলিশ সদরদপ্তর ছাত্র-জনতাসহ দেশবাসীর প্রতি লুণ্ঠিত অস্ত্র-গোলাবারুদ ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেরত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। প্রথম দফায় ১৯ আগস্ট পর্যন্ত সেই সময়সীমা ছিল। পরে কৌশলগত কারণে সেই সময়সীমা আরও বাড়ানো হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেরত দেন এবং দেরিতে জমা দেওয়ার যৌক্তিক কারণ দেখান তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মামলা বা আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (পুলিশ সুপার) ইনামুল হক সাগর জানান, ২৯ আগস্ট পর্যন্ত লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ৩ হাজার ৩০৪টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া উদ্ধার হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৯৭৪ রাউন্ড বুলেট, ২১ হাজার ৩৯৫টি টিয়ার গ্যাস সেল ও এক হাজার ৯৩৯টি সাউন্ড গ্রেনেড। সূত্র বলছে, ফেরত পাওয়া ও উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ মানুষ জমা দিয়েছেন। যার অধিকাংশই আবার জমা পড়েছিল বিভিন্ন মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। জমাদানকারীদের যাবতীয় তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। সম্প্রতি ডিএমপির নবনিযুক্ত কমিশনার ডিআইজি মো. মাইনুল হাসান জানান, আন্দোলনের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের ঢাকার প্রায় সব অফিস ও বক্স ভাঙচুর হয়েছে। ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২টি থানা। পুলিশের বহু যানবাহন ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লুণ্ঠিত হয়েছে ১ হাজার ৮৫৮টি অস্ত্র। যার মধ্যে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪৫৩টি অস্ত্র পাওয়া গেছে। আরও কিছু অস্ত্র বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। যেগুলো ঢাকা মহানগর পুলিশ ফেরত এসেছে। সংঘর্ষে ডিএমপির ১৪ জন পুলিশ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪২৭ জন। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেরত না আসায় সেগুলো পেশাদার সন্ত্রাসী বা অপরাধ চক্রের হাতে চলে গেছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। যদিও লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। তবে ভবিষ্যতে যে হবে না, সেটি হলফ করে বলা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যাতে ব্যবহৃত না হতে পারে, এজন্য দ্রম্নত লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে বলা হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবিএম নাজমুস সাকিব বলছেন, লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পুরোপুরি ফেরত না পাওয়ার কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মানুষের মধ্যে বাড়তি আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। এমনকি অনেকেই এ নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছেন। এ ছাড়া লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ যে এক সময় অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হবে না, সেটি হলফ করে বলা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, সরকারের তরফ থেকে বার বার লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। জমাদানকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলেও নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। তারপরও আশানুরূপ হারে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা হচ্ছে না। মূলত অস্ত্র লুণ্ঠনকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা থেকেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তবে লুণ্ঠিত সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ যে বিভিন্ন সন্ত্রাসী বা অপরাধী চক্রের হস্তগত হয়েছে, সেই ধারণাও হয়তো পুরোপুরি ঠিক না। কারণ অনেকেই হুজুগের মাথায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে গেছেন। তবে কোনো গোষ্ঠী বা কেউ সুযোগ বুঝেও অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করতে পারে। যা দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যেতে পারে। তাই লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় দেশে নাশকতার ঘটনা ঘটা বা জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর বলেন, পুলিশের বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে। যার পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ চলছে। যে কারণে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর ছাড়াও পুলিশের সব ইউনিট, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে পুরো দেশেই। লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত না আসার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তিনি আরও বলেন, লুণ্ঠিত বা খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংশ্লিষ্ট থানায় বা মসজিদের ইমামের কাছে জমা দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি বার বার আহ্বান জানানো হচ্ছে। কারণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমাদানকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর হয়তো সেই সুযোগ আর থাকবে না। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আরও জোরালো অভিযান চালানো হবে।