গ্রেপ্তার নেই, জেল নেই, জুলুম নেই, আদালতে প্রতিদিন হাজিরা নেই, আতঙ্ক নেই, উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা নেই, প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নেই। এ যেন অন্য রকম এক সময়। যেই সময়ের জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দেড় যুগ। ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে দলটির প্রতিকূলতা পিছু ছাড়েনি। ১৯৭৮ সালের ১ স্েেপ্টম্বর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি নানা উত্থান-পতনের মধ্যে সময় পার করলেও শেষ ১৮ বছর বিপর্যয় ছিল সবচেয়ে বেশি। গত দেড় যুগ আন্দোলন সফলের চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করলেও এবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া চ্যালেঞ্জ নিয়ে আজ ৪৬ বছরে পা দিচ্ছে দলটি।
এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বিএনপির কাছে কেন ব্যতিক্রম, এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে গত প্রায় দেড় যুগের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে ফুরফুরে অবস্থায় রয়েছে বিএনপি। কারণ, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি পেয়েছেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও দেশে ফেরার প্রক্রিয়া চলছে। নেতাকর্মীরাও 'মিথ্যা' মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কারাগার থেকে বের হয়ে আসছেন। সব মিলিয়ে সারাদেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি উদ্দীপ্ত ও চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। এরপরও জমকালো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন নেই দলটিতে। কারণ, এবার দেশের বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক বন্যা হয়েছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি সীমিত করেছে দলটি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা ছিল, সেটি বন্যার্তদের সহায়তায় ব্যয় করা হচ্ছে।
জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির এখন মূল লক্ষ্য- আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া। এ লক্ষ্যে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলের তৃণমূল নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলটি মনে করছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ইতিহাসের অন্যতম কঠিন পরীক্ষার নির্বাচন। তাই নেতাকর্মীদের জনগণের আস্থা নষ্ট করে- এমন কাজ পরিহার করে মানুষের পাশে থেকে তাদের মন জয়ের জন্য বলা হয়েছে। পাশাপাশি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চলছে।
এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর আব্দুল মঈন খান বলেন, 'বিএনপি সৃষ্টির ৪৬ বছর পর এসে আজ বিএনপির সামনে নতুন করে উন্মুক্ত হয়েছে এক বিশাল ক্যানভাস, যে ক্যানভাসে অঙ্কিত হবে গণতন্ত্রের নতুন সূর্য। যে স্বাধীনতার ঘোষণা এক দিন দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং যে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র, সেই গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায়ই আজ রচিত হয়েছে ছাত্র-জনতার বিপস্নব, যেমন সেদিন হয়েছিল বাক্শাল দূর করে সিপাহী-জনতার বিপস্নবের ভেতর দিয়ে। বাকশাল দূর করে বাংলাদেশে প্রথমবারের গণতন্ত্রের পুনরুত্থান ! স্বাধীনতা ও গতন্ত্রের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে দলটির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৮-এর ১ সেপ্টেম্বর, সেই দলটিই আজ আবার গণতন্ত্রের নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে আগামীতে এগিয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের জন্য আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে। অদূর ভবিষ্যতে এটি হবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে থাকবে না ক্ষমতার দম্ভ অথবা আস্ফালন, থাকবে না অত্যাচার-নির্যাতন, থাকবে না দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি। সেখানে থাকবে মেধার মূল্য, যেখানে মানুষ বুকভরে মুক্ত বাতাস নিঃশ্বাস নেবে, যেখানে কথা বলার অধিকার থাকবে, থাকবে ভোটের অধিকার, সর্বোপরি থাকবে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, যেখানে স্বৈরাচারী সরকারের বুলেটের গুলিতে আর কাউকে প্রাণ দিতে হবে না। এই মহান আদর্শে বিশ্বাসী হয়েই বিএনপি জনগণের জন্য রাজনীতি করে যাবে, আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে বিএনপি অতীতের ভুল ভ্রান্তি দূর করে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এই মহান দিবসে এই আমাদের প্রত্যাশা।'
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির। এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথমে পাঁচ দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু বন্যার কারণে পরে সেই কর্মসূচি সীমিত করা হয়। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এবার বর্ণাঢ্য কর্মসূচির আয়োজন থাকছে না। সীমিতভাবে কর্মসূচি পালিত হবে।
পরিবর্তিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ রোববার সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। এ ছাড়া দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে দেশের মানুষ ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতদের জন্য দোয়া করা হবে; বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাতে দ্রম্নত দেশে ফিরে আসতে পারেন, সে জন্য দোয়া করা হবে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভু্যত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮৩ সালে বিএনপির হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী খালেদা জিয়া। তিনি দলের চেয়ারপারসন হন। তিন বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন খালেদা জিয়া। সর্বশেষ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। ২০০৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে দলটি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি দুর্নীতির মামলায় দন্ডিত হয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এরপর ওইদিনই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, তার বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। তিনি লন্ডনে থেকে স্থায়ী কমিটির পরামর্শে দল পরিচালনা করছেন। সেখান থেকেই সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন তারেক রহমান।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে গত ১৫-১৬ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা-হামলা, জেল-জুলুম, গুম-খুন তথা নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। একই সঙ্গে দলটিকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হয়েছে।
নবম সংসদ নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি বিএনপির। এরপর ২০১১ সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় সংবিধানে তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দলটি। পরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও কোনো ফল হয়নি। এই নির্বাচনের আগে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনও বর্জন করে দলটি। বরং বিএনপি এবং মিত্রদের আন্দোলন ও বর্জনের মুখে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এমন অবস্থায় একদিকে হামলা-মামলা-নির্যাতন এবং অন্যদিকে সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনেও কাঙ্ক্ষিত ফল না আসায় সারাদেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও চরম হতাশা ভর করে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় হঠাৎ করে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। কোটাবিরোধী এই আন্দোলন যে একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হবে, শুরুতে সেটি কারোর ভাবনায় ছিল না। ছাত্রদের ওই আন্দোলনে বিএনপি সমর্থন জানায় এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ দলটির অন্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা এতে অংশগ্রহণও করে। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণঅভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, যেটি ছিল বিএনপির নেতাকর্মীদের বহুদিনের চাওয়া।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি লাভ করেন। ড. ইউনূসের সরকারকে সমর্থন জানিয়ে সার্বিক সহযোগিতার কথা জানায় বিএনপি। একই সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দলীয় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতদের জন্য। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার পাশাপাশি নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। তারেক রহমানের নির্দেশে দলের নেতাকর্মীরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষের পাশেও দাঁড়ায়।