দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ জনে। সবচেয়ে বেশি ১৯ জনের মৃতু্য হয়েছে ফেনীতে। বন্যাকবলিত এসব জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৪ লাখের বেশি মানুষ। এদিকে, পানি নেমে যাওয়ার পর ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে বন্যার ক্ষত। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করলেও কাটেনি দুর্ভোগ। পানির তোড়ে বসতির পুরোটাই যেন ধ্বংসস্তূপ! বানভাসি পরিবারগুলো সব হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। এখন তাদের শুরু হয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। অন্যদিকে, বিপন্ন মানুষের মাঝে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বন্যা উপদ্রম্নত এলাকার সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে।
শুক্রবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ফেনী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সিলেট, লক্ষ্ণীপুর ও কক্সবাজারের ৬৪টি উপজেলা বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন বা পৌরসভার সংখ্যা ৪৮৬টি। এসব জেলায় অন্তত ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৫৪ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ জন মানুষ।
ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ জনে। জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯ জনের মৃতু্য হয়েছে ফেনীতে। এছাড়া কুমিলস্নায় ১৪ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, খাগড়াছড়িতে ১ জন, নোয়াখালীতে ৮ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্ণীপুরে ১ জন কক্সবাজারে ৩ জন এবং মৌলভীবাজারে ১ জন মারা গেছেন; নিখোঁজ রয়েছেন একজন। এর আগে বৃহস্পতিবার বন্যায় ৫২ জনের মৃতু্যর খবর দিয়েছিল ত্রাণ মন্ত্রণালয়। আর ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা জানিয়েছিল ৫৫ লাখের বেশি।
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পানিবন্দি-ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য দুর্গত এলাকাগুলো ৩ হাজার ২৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৬৮৭ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আর ৩৮ হাজার ১৯২টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে এসব এলাকায় ৫৬৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে
বৃষ্টিপাত কমে দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
শুক্রবার সকালে কেন্দ্রের বুলেটিনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের উজানে উলেস্নখযোগ্য বৃষ্টিপাত কেবল মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূল স্টেশনে ৫৪ মিলিমিটার নথিবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে অন্য কোথাও উলেস্নখযোগ্য বৃষ্টিপাত নেই।
কেন্দ্র বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মনু নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যান্য প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে এ সময় এ অঞ্চলের মনু, খোয়াই, ফেনী, মুহুরি, গোমতী, তিতাস ইত্যাদি নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
এছাড়া দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস না থাকায় এ সময় এ অঞ্চলের সাঙ্গু, মাতামুহুরি, কর্ণফুলী, হালদা ও অন্যান্য প্রধান নদীর পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে।
বানভাসিদের ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম
স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ফেনীর বন্যার ক্ষত ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে মানুষ ফিরতে শুরু করলেও কাটেনি দুর্ভোগ। তাদের ঘর-বসতির পুরোটাই যেন ধ্বংসস্তূপ! বানভাসি পরিবারগুলো সব হারিয়ে পথে বসার উপক্রম।
বানের পানি কমার খবরে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে হাসি মুখে বাড়ি ফেরেন ফুলগাজীর ষাটোর্ধ্ব সগুরা খাতুন। কিন্তু সেই হাসি ফিকে হয়ে যায় মুহূর্তেই। সাজানো-গোছানো ঘরটার কিছুই অক্ষত নেই। খাট, পালঙ্ক, টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, দলিল-দস্তাবেজ বানের পানি ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।
ফেনী শহরের মাস্টারপাড়া এলাকার ওষুধ দোকানি কার্তিক বাবু। দোকানে ছিল ৬ লক্ষাধিক টাকার ওষুধ। বন্যার পানি কমার পর দোকান খুলে দেখেন দোকানের অধিকাংশ আসবাব নষ্ট হয়ে গেছে। ওষুধগুলোও আর বিক্রির যোগ্য নেই। সব হারিয়ে যেন শূন্যে অবস্থান তার।
সব হারানোর এমন গল্প একটা দুটো নয় শত শত। ঘর-বসতির আসবাব, কাপড়চোপড় থেকে ব্যবসার পুঁজি। সব হারিয়ে দিশেহারা মানুষগুলো।
ইতোমধ্যে জেলার কৃষিখাতে প্রায় হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি নিরূপণ করা গেলেও রাস্তা-ঘাট অবকাঠামো এবং মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সার্বিক ক্ষতি এখনো নিরূপণ করা যায়নি। তবে বিভিন্ন মহল থেকে ধারণা করা হচ্ছে এ বন্যায় ফেনীতে ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে ২০ হাজার কোটির বেশি।
এদিকে বন্যাপরবর্তী স্থানীয়দের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে মাঠে কাজ করছে সেনা, নৌবাহিনী। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এ বন্যায় দ্রম্নত উদ্ধার কার্যক্রমে সশস্ত্র বাহিনীকে মাঠে দেখেছে স্থানীয়রা।
জেলা প্রশাসক মোসাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, 'ফেনীতে বন্যায় ১৯ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। সরকারের নির্দেশনা পেলে তারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের বিষয়ে কাজ শুরু করবেন।'
কুমিলস্নায় বন্যার পানি কমছে, বাড়ছে রোগবালাই
কুমিলস্নার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করায় পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে কমেনি মানুষের দুর্ভোগ। সেইসঙ্গে দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত নানা রোগবালাই। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটে ভেসে উঠছে ময়লা-আবর্জনা। ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ। তার মধ্যে ডায়রিয়াসহ নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বানভাসিরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। দূষিত পানি পান ও বন্যার পানিতে চলাফেরার কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে ব্যথা, জ্বরের পাশাপাশি চর্মরোগ, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও চোখের প্রদাহের রোগীর সংখ্যাই বেশি। আক্রান্তদের অধিকাংশই শিশু।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সেও রোগীদের ভিড় লেগে রয়েছে। এরই মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে।
৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি আছেন ৬০ জন। এরমধ্যে ১৬ জন পুরুষ, ২০ জন নারী ও ২৪ জন শিশু। তাদের ৩৬ জনই ডায়রিয়া আক্রান্ত। শিশুদের বেশিরভাগই ভুগছে ডায়রিয়ায়।
চৌদ্দগ্রামের মুন্সিরহাট এলাকার নূরজাহান আক্তার তার ৩ বছর বয়সি মেয়ে আদিবাকে নিয়ে বুধবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, 'বন্যার পানিতে সাত দিনের বেশি ঘরবন্দি ছিলাম। মঙ্গলবার দুপুর থেকে মেয়ের ডায়রিয়া শুরু হয়। পরে পানি অতিক্রম করে তাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু অতিরিক্ত রোগীর চাপে ডায়রিয়ার কোনো ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না।'
স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের সিনিয়র নার্স হাসিনা বেগম বলেন, 'হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৬০ জন রোগীর অধিকাংশই বন্যাকবলিত এলাকা থেকে আসা। রাত হলেই রোগীদের চাপ বাড়তে থাকে। ভর্তিদের অধিকাংশ ডায়রিয়া আক্রান্ত। যার মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি।'
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বলেন, 'বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দিন যত যাবে, রোগীদের সংখ্যা তত বাড়তে পারে। বন্যায় হাসপাতালটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্টোর রুমে যত ওষুধ ছিল সব পানিতে নষ্ট হয়েছে। যার কারণে ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।'
রাজশাহীতে কমতে শুরু করেছে পদ্মা নদীর পানি
এদিকে, রাজশাহীতে পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়ার পর নদীটির পানি বৃহস্পতিবার ৪ সেন্টিমিটার বেড়েছিল। শুক্রবার সকাল থেকে তা আবার কমতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার রাজশাহী পয়েন্টে পানির উচ্চতা বেড়ে হয়েছিল ১৬ দশমিক ৩৪ সেন্টিমিটার। শুক্রবার সকাল ৬টায় সেই পানি ২ সেন্টিমিটার এবং সকাল ৯টায় আরও ১ সেন্টিমিটার কমেছে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, গত সোমবার সকাল ৬টায় রাজশাহী পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ২৯ মিটার। ওইদিন বেলা ৩টায় পানি ১ সেন্টিমিটার বেড়ে ১৬ দশমিক ৩০ মিটারে দাঁড়ায়। এরপর গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজশাহী পয়েন্টে পানির উচ্চতা একই ছিল। গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত সময়ে ওই পয়েন্টে পানির উচ্চতা ৩ সেন্টিমিটার বাড়ে। তখন পানির উচ্চতা দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩৩ মিটার। একই দিন সন্ধ্যা ৬টায় পানি আরও ১ সেন্টিমিটার বাড়ে। তখন রাজশাহী পয়েন্টে পানির মোট উচ্চতা দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩৪ মিটার। আজ সকাল ৬টায় তা থেকে ২ সেন্টিমিটার কমে যায়। সকাল ৯টায় আরও ১ সেন্টিমিটার কমেছে। রাশাহীতে পদ্মা নদীর পানির বিপৎসীমা ১৮ মিটার। ফলে এখনো এর ১ দশমিক ৬৯ মিটার নিচ দিয়ে পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছে।