সন্তানহারা মা, নিখোঁজ বাবার সন্তান, তুলে নিয়ে গেছে এমন ভাইয়ের বোন, বেহদিস স্বামীর স্ত্রীসহ স্বজনহারা মানুষের অশ্রম্নতে সিক্ত হলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর। আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে শুক্রবার সকালে আপনজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছিলেন স্বজনহারা মানুষ। অশ্রম্নসিক্ত কণ্ঠে তারা জানতে চান, স্বজনরা কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বেঁচে আছেন কি না? মেরে ফেলা হলে কোথায় তাদের কবর দেওয়া হয়েছে? তাদের দাবি, দেশে যেন আর কোনো অজুহাতেই এমন অমানবিক গুমের ঘটনা না ঘটে। একজন মানুষও যেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার না হন।
শুক্রবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে গত ১৫ বছরে গুম হওয়া স্বজনদের সংগঠন 'মায়ের ডাক'। এখানেই গুম হওয়াদের স্বজনরা এসব কথা বলেন। তাদের সঙ্গে গুম অবস্থা থেকে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমা, সাবেক কূটনীতিক মারুফ জামান ও সঙ্গীতশিল্পী রানা যোগ দিয়ে নিজেদের গুম হওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি নিয়ে তাদের স্বজনেরা দীর্ঘ মানববন্ধন করেন শহীদ মিনার চত্বরে। তাদের কারও সন্তান ১৩ বছর ধরে নিখোঁজ, কারও বাবাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল এক যুগ আগে। কারও স্বামীকে গুম করা হয়েছে ১০ বছর আগে। এমন অনেক পরিবার এই দীর্ঘ সময় ধরে তাদের অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা, আতঙ্ক, আর্থিক ও নানা ধরনের ক্ষতি এবং হয়রানির কথা বলেন। এসব বলতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা অভিযোগ করেন, এতদিন তাদের কষ্টের কথা বলতে দেওয়া হয়নি। পথে দাঁড়ালেই পুলিশ হামলা করে তুলে দিয়েছে।
'আমি আমার ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই, আমার বাবার সঙ্গে কী হয়েছে। বলা হচ্ছে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন দেশে আমার বাবাকে ফেরত চাই'- মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন কিশোরী আনিশা ইসলাম।
২০১৯ সালের ১৯ জুন রাজধানীর শাহ আলী মাজারসংলগ্ন নিজের কাঠের দোকান থেকে নিখোঁজ হন আনিশার বাবা ইসমাইল হোসেন বাতেন। এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি। গত পাঁচ বছর ধরে বাবার ছবি হাতে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন আনিশা। তার ছোট ভাই প্রতি রাত অপেক্ষা করে বাবা কখন ফিরবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চারদিকে যখন গুম-খুনের অবসান আর ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রম্নতি আসছে, আনিশাও চান তার পরিবার ন্যায়বিচার পাক।
মানববন্ধন থেকে জামাল উদ্দিন বলেন, ২০১৭ সালে তুলে নেওয়া তার ছেলে ইশরাক উদ্দিনের কথা। তিনি বলেন, 'ছেলেকে হারানোর পর থেকে পরিবার থেকে সব আনন্দ, উৎসব হারিয়ে গেছে।'
২০১৪ সালে আবদুল কাদেরের গুম হওয়ার কথা বলতে গিয়ে তার মা অয়েশা আলী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তনি বলেন, 'সবাই বলছে, দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমার জন্য এখনো দেশ স্বাধীন হয়নি। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। জানি না, সে বেঁচে আছে কি নাই।'
কিশোরী লামিয়া আক্তার জানায়, ২০১৩ সালে তার বাবা কাওসার হোসেনকে যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন তার বয়স ছিল ৩ বছর। বাবার মুখটা তার মনে পড়ে না। কাঁদতে কাঁদতে বাবার মুখটা দেখার আকুতি জানায় লামিয়া। সে বলে, 'আমি বাবার মুখটা দেখতে চাই। বাবা বলে ডাকতে চাই।'
মানববন্ধন থেকে সৈয়দা শাম্মি সুলতানা বলেন, '২০১৩ সালে তার স্বামী খালেদ হাসানকে তুলে নেওয়ার পর থেকে শুধু কান্না নিয়েই দিন কাটছে তার সংসারে।' রিনা আলম জানান, ২০১৫ সালে তার স্বামী নূর আলমকে তুলে নেওয়ার পর থেকে কত জায়গায় যে খোঁজ করতে ছুটে গেছেন সেই যন্ত্রণার কথা। 'স্বামী যদি মারাও গিয়ে থাকেন, তাহলে অন্তত তার কবরটি কোথায় আছে, তা জানতে পারলে সন্তানদের নিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারতাম'-বলেন তিনি।
মাজহারুল ইসলামের বোন লাবণী জানান, ২০১২ সালে তার ভাইকে গুম করা হয়। এতদিন তারা তাদের কষ্টের কথা ভালো করে বলতে পারেননি। রাস্তায় মানববন্ধন করতে গেলে পুলিশ দিয়ে তাদের ওপর হামলা করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ''আমরাও মানুষ। আমাদের মধ্যেও আবেগ আছে, প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা আছে। আমাদের কষ্টের কথাটুকু বলতে দেওয়া হয়নি। শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন বাহিনীর 'আয়নাঘর' নামের অনেক বন্দিশালা আছে। যেখানে যত আয়নাঘর আছে, সব খুলে দিয়ে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হোক।''
মানববন্ধনে যোগ দেওয়া স্বজনহারা ব্যক্তিরা জানান, স্বজনদের ফিরে না পেলে তাদের কাছে এই গণ-অভু্যত্থান, এই নতুন অর্জন অর্থহীন হয়ে যাবে।
শহীদ মিনারে মাইকেল চাকমা বলেন, 'আমাকে ৫ বছর তিন মাস গুম করে রাখা হয়েছিল। আলো-বাতাসহীন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এই কষ্টটা আমি জানি। দিনের পর দিন সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে। এটা শুধু বেঁচে থাকা নয়, অনেকটা মৃতু্যর মতো। এটা বুঝি, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার কত কষ্টে দিন কাটায়। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার আমলে কোনো ডেমোক্রেসি ছিল না। মানবাধিকার ছিল না, মানুষের নিরাপত্তা ছিল না। হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে যে গুম-খুন করেছে, তার একটা সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার হতে হবে।'
মায়ের ডাকের এই সমাবেশ ও মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করতে এসেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাসহ ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে। তাদের মধ্যে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপস্নবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় নেতা ফয়জুল হাকিম, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের জ্যেষ্ঠ গবেষক তাসকিন ফহমিনা, আইনজীবী সারা হোসেন, সঙ্গীতশিল্পী সায়ান, সাংবাদিক সাঈদা গুলরুখসহ অনেকেই।
বক্তারা বলেন, অন্তর্র্বর্তী সরকার ইতোমধ্যেই গুম হওয়ার তদন্ত করতে কমিশন গঠন করেছে এবং প্রধান উপদেষ্টা এসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছেন। এটা খুবই আশাপ্রদ ঘটনা। যারাই গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত থাকুন না কেন, সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক সাজা কার্যকর করতে হবে। দেশের সব ছাত্র-জনতা এই সরকারের সঙ্গে আছে।
তারা আরও বলেন, দেশে কোনো এলিট ফোর্সের প্রয়োজন নেই। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের সঙ্গে জড়িত এইর্ যাব বাহিনী বিলুপ্ত করতে হবে। দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি মানবিক দেশ গঠন করতে হবে।
মানববন্ধন ও সমাবেশে সমাপনী বক্তব্যে মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম জানান, ২০১৩ সালে তার ভাইকে গুম করা হয়েছে। তখন থেকেই গুম হওয়া স্বজনদের নিয়ে এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এতদিন তারা তাদের বেদনার কথা বলতে পারতেন না।
অবিলম্বে সব আয়নাঘর, সব বন্দিশালা ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'জনগণের অর্থে কোনো বাহিনী যেন কোনো বন্দিশালা গড়ে তুলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। গুম হওয়া মানুষদের মুক্তি ও তাদের বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করতে হবে।'