বন্যার্ত এলাকায় স্থবির অর্থনীতি

প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
নোয়াখালীসহ দেশের ১১ জেলার চলমান বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। তবে বেশিরভাগ রাস্তাঘাট, ফসলের খেত, গবাদি পশুর খামার ও শিল্পকারখানা থেকে পানি পুরোপুরি নেমে না যাওয়ায় প্রায় সব ধরনের কৃষিজ, ব্যবসায়িক এবং ক্ষুদ্র-মাঝারিসহ সব ধরনের উৎপাদনশীল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে সেখানকার অর্থনীতি এখনো স্থবির। বানের পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর এ সংকট সহসা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রগুলো বলছে, অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের ২৪টি জেলার কৃষি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে দেশের ১১টি জেলার ৫৪১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের ক্ষতি ছাড়াও এসব অঞ্চলের বসতবাড়ি, অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ক্ষতি হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জেলাপর্যায়ে কৃষিবহির্ভূত অন্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। বিশেষ করে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামীণ অর্থনীতির বিভিন্ন উপখাত এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর আশপাশের জেলাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। বসতবাড়ি ও অবকাঠামো মিলিয়ে এসব খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। আর কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ছাড়িয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত বন্যায় দেশের আর্থিক ক্ষতি অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে টানা দেড় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান বন্যায় অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে যে বিপুল অঙ্কের ক্ষতি হয়েছে তা হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পরও কৃষি ও ব্যবসাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করতে অনেকটা লম্বা সময় লাগবে। কেননা বন্যার্ত এলাকার ভেঙে যাওয়া রাস্তাঘাট মেরামত করার আগে পরিবহণ চলাচল অসম্ভব। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কাঁচামাল, ফসলের বীজ-সার, ব্যবসায়িক মালামাল আনা-নেওয়া কঠিন হবে। এছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, খামার ও শিল্পকারখানা বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা সংস্কারের আগে চালু করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ফসলের খেত \হচাষযোগ্য করতে তুলতেও অনেকটা সময় লাগবে। সব মিলিয়ে বন্যাকবলিত এলাকার অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি সচল করতে তুলতে আরও এক দেড় মাস সময় লাগবে। তবে এ সময় পরও সেখানকার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র শিল্পমালিক, গবাদি পশু-মৎস্য খামারি ও কৃষকদের অনেকের পক্ষেই নতুন করে পুঁজি যোগাড় করা অসম্ভব। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ না পেলে তাদের আগের কর্মক্ষেত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ঋণ নিয়ে যারা পুঁজি বিনিয়োগ করে বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন তাদের অনেকের ভিটেমাটি বিক্রি করতে হবে। এতে বন্যার্ত এলাকার নিম্নবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশ অতি দরিদ্রের সারিতে গিয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলা ১১টি। সেগুলো হলো : ফেনী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্ণীপুর ও কক্সবাজার। এসব জেলার ৭৩টি উপজেলা বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৫২৮। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় ২৪টি জেলার কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ১৭ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ করা হয়েছিল। এসব ফসলের মধ্যে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬৭৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে এসব জেলার অন্তত ২০ শতাংশ ফসলি জমি বন্যায় আক্রান্ত। ক্ষতির শিকার হওয়া আবাদি জমির মধ্যে রয়েছে- আউশ ৭০ হাজার ৬১৯ হেক্টর, আমন দুই লাখ ২০ হাজার ৬৩৪ হেক্টর, বোনা আমন চার হাজার ৩৫১ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ১৯ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। এছাড়া শাকসবজি ১৫ হাজার ৫৬১ হেক্টর, আদা ১৬১ হেক্টর, হলুদ ২৪৬ হেক্টর, আখ ৬৫৭ হেক্টর, পান ৬৪৭ হেক্টর, ফলের বাগান ১১ হাজার ৮০০ হেক্টর, মরিচ ১২৭ হেক্টর, তরমুজ ৫৬ হেক্টর, পেঁপে ২৩ হেক্টর, ভুট্টা তিন হেক্টর, পেঁয়াজ এক হেক্টর ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো ১৫ হেক্টর। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা। কৃষি বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব জমিতে প্রায় ২০ লাখ টনের বেশি শস্য উৎপাদন সম্ভব হতো। যদি পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে না করা যায়, তাহলে কৃষিজ পণ্য উৎপাদন ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে আকস্মিক বন্যায় মৎস্য খাতে ১২টি জেলার ৮৬টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি পুকুর, দিঘি ও মৎস্য খামার। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। মাছের পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ক্ষতির শিকার হয়েছে তিন হাজার ৭৪৬ লাখ। ফলে মৎস্য খাতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এছাড়া বন্যার কারণে অনেক গবাদি পশুর মৃতু্য ও ভেসে যাওয়াসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্ট হয়েছে। ডিম, দুধ ও অনান্য খাতও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে পশুসম্পদ খাতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৪১১ কোটি টাকা। গত ২৫ আগস্ট পর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ক্ষতি ছাড়িয়েছে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ভয়াবহ বন্যায় সেখানে প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল। সাত দিন পর পরিস্থিতি উন্নতি হলেও এখন ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। একের পর ভেঙে পড়েছে মাটির ঘর। কীভাবে নতুন করে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই অনেকের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার করেরহাট ইউনিয়ন থেকে মিঠানালা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় অনেক মাটির ঘর টানা সাত দিন ডুবে ছিল। পানি কমার পর ওই এলাকায় প্রায় শতাধিক মাটির ঘর ভেঙে পড়ছে। এসব ঘরের মালিক বেশির ভাগ দরিদ্র। তাদের চলতে কষ্ট হয়। তার ওপর মাথা গোঁজার ঠাঁই চলে যাওয়ায় দু'চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের আজমনগর গ্রামের চিত্র আরও ভয়াবহ। পাশের হিঙ্গুলী খাল হয়ে ফেনী নদীর পানির তোড়ে এখানে প্রায় সবকটি কাঁচাঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানকার খামারের গরু-মুরগি ভেসে গেছে বানের জলে। পুকুরে মাছ নেই, ক্ষেতে নেই ফসল। গ্রামের আনোয়ার অ্যাগ্রো অ্যান্ড ডেইরি ফার্মের মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, বন্যার প্রথম দিক থেকে পুরো গ্রাম ডুবে যায়। পাশে হিঙ্গুলী খাল হওয়ায় এক রাতেই গ্রাম পস্নাবিত হয়। গ্রামের কোনো কাঁচাবাড়ি অক্ষত নেই। মানুষের হাঁস-মুরগি, খামারের গরু-মুরগি সব ভেসে গেছে। গ্রামের মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে বহুমুখী সহযোগিতা ছাড়া কখনো সম্ভব হবে না। উপজেলার ওচমানপুর ইউনিয়নের প্রায় সবকটি গ্রাম টানা ছয় দিন বন্যার পানিতে ডুবেছিল। বৃহস্পতিবার আজমপুর, মুহুরী প্রজেক্ট ও বাঁশখালী গ্রামের বানভাসি মানুষ এখনো সড়কের পাশে দোকানপাটে আশ্রয় নিয়ে আছে। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির সমীক্ষার তথ্য দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসক মাহফুজা জেরিন বলেন, বন্যায় উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে সমীক্ষা কমিটি হয়েছে। তারা প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাসগৃহ, টিউবওয়েল ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার সমীক্ষা চালাবে। পরবর্তীতে অন্যান্য ক্ষতির সমীক্ষাও করবে। এদিকে লক্ষ্ণীপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, সেখানকার প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। এছাড়া প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। পুরো এলাকা ৩-৪ ফুট পানিতে নিমজ্জিত। প্রত্যেকটি টিউবওয়েল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেওয়ায় অনেকেই বাজার থেকে পানি কিনে খাচ্ছেন। লক্ষ্ণীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা এখনো বন্যার পানিতে ভাসছে। তবে পানি কমতে শুরু করেছে। রায়পুর ও রামগঞ্জ উপজেলায় উলেস্নখযোগ্যভাবে পানি কমেছে। নদীতে ভাটা পড়লেই দ্রম্নত পানি নিষ্কাশনের জন্য মজুচৌধুরীর হাট এলাকার দুটি সস্নুইস গেটের কপাটগুলো খুলে দেওয়া হয়। কুমিলস্নায় এবারের বন্যায় শুধুমাত্র কৃষি খাতে ৮৪৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার কুমিলস্না জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, বন্যায় জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলার ৬৩ হাজার ৭৯৪ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে রোপা আমন বীজতলা ৪ হাজার ৫১৫ হেক্টর ও ধান ২৩ হাজার ৩০৯ হেক্টর, শাকসবজি ২ হাজার ১৯ হেক্টর, রোপা আউশ ৩৩ হাজার ৫৮০ হেক্টর, বোনা আমন ৩৩৫ হেক্টর এবং ২১৬ হেক্টর আখ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে আছে ২২৩ কোটি ৪১ লাখ টাকার রোপা আমন বীজতলা, ২৬৯ কোটি ৯৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকার রোপা আমন, ৪৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকার শাকসবজি, ২৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ৭২ হাজার টাকার রোপা আউশ ও ৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকার আখের ফসল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে চলমান বন্যায় ১১ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বন্যায় মোট ৫২ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে ৩৯ জন পুরুষ, ৬ জন নারী ও ৭ শিশু রয়েছেন। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ছিল ৩১ জন। এই ৫২ জনের মধ্যে কুমিলস্নায় ১৪, ফেনীতে ১৭, চট্টগ্রামের ৬, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ৮, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্ণীপুরে ১, কক্সবাজারের ৩ ও মৌলভীবাজারে ১ জনের মৃতু্য হয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত সচিব।