অবিরাম বর্ষণ ও ভারতের উজানের পানিতে দেশের ১১ জেলায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি কোথাও উন্নতি ও কোথাও অবনতি হয়েছে। দেশের বেশিরভাগ নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। কমেছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা। শুধু কুমিলস্নায় গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে বইছে। তবে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে লক্ষ্ণীপুরে। ধীরে পানি নামলেও বন্যা আক্রান্তদের বিপদ কাটছে না। চারদিকে থইথই পানি হলেও পানযোগ্য পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবার মিললেও পানি মিলছে অল্প পরিমাণে। পান করতে হচ্ছে খুব হিসাব করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, দেশের চলমান ভয়াবহ বন্যার মধ্যে ভারত ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেট খুলে দিলেও তাতে নতুন করে কোনো এলাকা পস্নাবিত হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কমেছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা, তবে মৃতু্য বেড়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম জানান, ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেট খুলে দেওয়ায় নতুন কোনো এলাকা পস্নাবিত হয়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা সাংবাদিকদের জানান, সপ্তাহ খানেক ধরে দেশে যে বন্যা চলছে তাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো পানিবন্দি আছে ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার। বর্তমানে ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন।
উজানের তীব্র ঢল এবং অতি ভারী বৃষ্টির কারণে গত মঙ্গলবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে তা
বিস্তৃত হয় ফেনী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্ণীপুর ও কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত সচিব জানান, বন্যায় নতুন করে চারজন মারা যাওয়ায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭। এর মধ্যে কুমিলস্নায় মারা গেছে ১০ জন, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে পাঁচজন করে এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছে। এছাড়া ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্ণীপুরে মারা গেছে একজন করে।
দুর্গতদের জন্য তিন হাজার ৮৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে পাঁচ লাখ ৯ হাজার ৭২৮ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পাশাপাশি ৩৪ হাজার ৪২১টি গবাদি পশুও সেখানে আশ্রয় পেয়েছে। দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে। বন্যা উপদ্রম্নত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে।'
বিপৎসীমার ওপর পানি কেবল কুমিলস্নায়
মঙ্গলবার উজানের তথ্যের ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, এদিন সকাল ৯টায় কুমিলস্না স্টেশনে গোমতীর পানি ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় এ নদীর পানি কমেছে ৩২ সেন্টিমিটার। ফেনীর পরশুরাম পয়েন্টে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে অবস্থান করছে।
সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুলেটিনে বলা হয়েছে, দেশের পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিলস্না ও ফেনীর বিভিন্ন নদীর পানি অন্তত আগামী ২৪ ঘণ্টা সমতল হ্রাস পাবে। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সাঙ্গু, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, হালদাসহ অন্যান্য নদীর পানিও সমতল হ্রাস পেতে পারে বলে বুলেটিনে জানানো হয়েছে।
নোয়াখালীতে ঝলমলে রোদ, জনমনে স্বস্তি
টানা দুই দিন পর নোয়াখালীতে মঙ্গলবার দুপুরে ঝলমলে রোদের দেখা মেলে। এতে জনমনে স্বস্তি বিরাজ করেছে। তবে বন্যার পানিতে এখনো ডুবে আছে জেলার আট উপজেলা। ডুবে আছে বসতঘর ও সড়ক। নোয়াখালীর ৮ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। ১১৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ২ লাখ ১৬ হাজার মানুষ।
পানযোগ্য পানির তীব্র সংকট
লক্ষ্ণীপুরের লিলি বেগমের বয়স ৬০ ছুঁয়েছে। প্রায় দুই ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে তার বাড়ি। বাড়ির সামনে যে নলকূপটি ছিল, সেখান থেকে তারা সাতটি পরিবার পানি সংগ্রহ করতেন। এখন সেই নলকূপটিও ডুবে গেছে। চারদিকে থইথই পানি হলেও পানযোগ্য পানির তীব্র সংকট। পরিবারের সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠলেও দুর্ভোগ কমেনি তাদের। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবারদাবার মিললেও পানি মিলছে অল্প পরিমাণ। পান করতে হচ্ছে খুব হিসাব করে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলার ৯০ ভাগ এলাকাই এখন পানির নিচে। এতে ৭ লাখ ২৪ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ডুবে গেছে, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি ক্ষেত ও বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কোথাও কোথাও চার-পাঁচ ফুট পানি রয়েছে। জেলা সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ৫৮টি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে।
ফেনীতে বিধ্বস্ত বাড়িঘর, মানুষ যাবে কোথায়?
ফেনী থেকে পাঁচ দিন পর নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। ভেসে উঠতে শুরু করেছে ডুবে থাকা বাড়িঘর। কিন্তু সেগুলোতে গিয়ে মানুষ উঠবে, এমন পরিস্থিতি নেই। পানির স্রোতে নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় সবকিছু। তাই আশ্রয়কেন্দ্রেই কাটছে দিন, যারা ছাড়ছেন তারা কাছে বা দূরে স্বজনদের বাড়িতে ছুটছেন। এ যেন এক অনিশ্চয়তাকে পেছনে ফেলে আরেক অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানো। এদিকে বন্যার ব্যাপকতায় বিদু্যৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকায় যোগাযোগও করতে পারছেন না কেউ।
ফেনী শহর থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও পানি আটকে আছে বিভিন্ন সড়কে। শহর থেকে বের হয়ে অন্য উপজেলার দিকে যেতে চাইলেই এখনও ভাঙতে হচ্ছে হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পর্যন্ত। এ অবস্থায় ত্রাণবাহী ট্রাক ছাড়া সেসব উপজেলার সঙ্গে চলাচলের নেই কিছু। কোথাও কোথাও পানি নেমে যাওয়ায় নৌকাতেও পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে হেঁটেই চলতে হচ্ছে মানুষকে।