নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসীতে অবস্থিত গাজী টায়ার কারখানার আগুন ২২ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট রোববার রাত ১০টা থেকে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েও সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন লাগার আগে কারখানার ভেতরে ঢোকা অন্তত ১৮৭ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে তাদের স্বজনরা দাবি করেছেন। তবে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দমকল কর্মীরা সেখান থেকে কোনো মৃত দেহ উদ্ধার করেনি। কারখানার ভেতরে জীবিত বা মৃত কেউ আছে কিনা তা-ও নিশ্চিত করতে পারেনি দমকল বাহিনী।
সোমবার বিকালেও কারখানার বিভিন্ন অংশে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কারখানার ভেতরে টায়ার উৎপাদনের কেমিক্যালসহ নানা ধরনের অতিদাহ্য পদার্থ মজুত থাকায় দীর্ঘ সময়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে দমকলকর্মীরা এখনো কারখানার ভেতরে ঢুকতে পারেননি। ফলে সেখানে আগুনে পুড়ে কেউ মারা গেছে কিনা তা জানা সম্ভব হচ্ছে না।
স্থানীয়রা জানায়, রোববার রাত ৯টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত গাজী টায়ারের কারখানায় ব্যাপক লুটপাট চালায়। খবর পেয়ে কারখানার আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকার শত শত মানুষ এতে যোগ দেয়। তারা কারখানার মূল্যবান মালামাল কে কার আগে লুট করতে পারে এজন্য যে যার মতো করে বিভিন্ন ফ্লোরে ঢুকে পড়ে। এ সময় কারখানার নিচের দিকের একাধিক ফ্লোরে আগুন ধরলে ওপরের দিকের ফ্লোরে থাকা লোকজন আটকা পড়ে। তাদের বেশিরভাগই আর বাইরে বের হতে পারেনি। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এখনো জানা যায়নি। তবে নিখোঁজ মানুষের স্বজনরা অনেকেই মোবাইলে ফোন করে তা বন্ধ পেয়েছেন। তাই তারা বেঁচে আছেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
এদিকে স্বজনদের দাবির ভিত্তিতে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ১৮৭ জন নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি তালিকা করছে বলে জানা গেছে। তবে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ঢাকা) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম জানান, তারা এ ধরনের কোনো তালিকা তৈরি করেননি। তবে অনেকেই স্বজন নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে স্বীকার করেন তিনি।
এদিকে ভেতরে কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ আটকা পড়েনি এবং তাদের কেউ নিখোঁজ নেই বলে দাবি করেছেন গাজী টায়ার কর্তৃপক্ষ।
কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম জানান, রোববার বিকাল থেকে কয়েকশ' মানুষ কারখানার ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। লুটপাট শেষে রাতে একাধিক ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে এলেও তারা দীর্ঘ সময়েও
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। লুটপাট ঠেকাতে পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল কারখানার ফটকের সামনে আসে। কিন্তু ১০ মিনিটের বেশি তারা দাঁড়াননি অভিযোগ করেন সাইফুল ইসলাম।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের অন্তত ২০ জন স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা রোববার রাতে গাজী টায়ার কারখানায় লুটপাট চলাকালীন সময়ে ভেতরে ছিলেন। এরপর রাতভর তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
সোমবার দুপুরে গাজী টায়ারের জ্বলতে থাকা কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিলেন মনি আক্তার নামে এক নারী। কারখানাটির অদূরে কলাবাগ এলাকার বাসিন্দা মনি জানান, তার স্বামী মো. রাশেদ রোববার সাড়ে ৮টার দিকে গাজী টায়ার কারখানায় এসেছিলেন। ওই এলাকারই আরেক বাসিন্দা তখন তার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু রাতে তার স্বামীর বাসায় না ফেরায় তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেন। কিন্তু তিনি তার ফোন বন্ধ পান।
মনি জানান, তার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করে। রোববার সন্ধ্যায় কাজ শেষে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া করছিল। এ সময় এক প্রতিবেশীর ফোন পেয়ে গাজী টায়ার কারখানায় যায়। তবে কেন সেখানে গিয়েছিল তা মনি আক্তারের জানা নেই।
কারখানার সামনে দুই বছরের ছেলে আদনানকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন গৃহবধূ রুবি বেগম। তিনি বলেন, তার স্বামী মো. সজিব (২৬) রোববার রাত ৯টা থেকে নিখোঁজ। সজিব রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন জানিয়ে রুবি বলেন, 'কারখানায় লুটপাট হইতাছে শুনে সজিব কারখানায় আসে। রাত ৯টায় শেষবার কথা হয়। তখন সে কারখানায়ই ছিল। পরে আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।'
এছাড়া সিমেন্ট কারখানার কর্মী আব্দুর রহমান (৩০), ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. সুজন (২৮), তার বোন মাফিয়া বেগম (৩০), বোনের স্বামী মো. রতন (৩৫), বড়ালু এলাকার রাজমিস্ত্রি হাসান আলী (৩২), তার দুই বন্ধু অহিদ (৩২) ও রুবেল (৩০), মুদি দোকানি শাহাদাত সিকদার (২৯), তার ভাই সাব্বির সিকদার (২৫) এবং স্থানীয় একটি অ্যাগ্রো ফার্মের রাখাল মো. শাওনসহ (১২) দেড় শতাধিক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন, উৎসুক লোকজনের সঙ্গে তারা কারখানার ভেতরে ঢুকেছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে তারা নিখোঁজ রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, সোমবার সকাল থেকেই কারখানার সামনে নিখোঁজ মানুষের স্বজনেরা ভিড় জমাতে থাকেন। তখন ফায়ার সার্ভিস নিখোঁজের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৮৭ জনের নিখোঁজের তালিকা করেছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ঢাকা) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম বলেন, স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক এই তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা করার পর তা পুলিশকে দেওয়া হবে। পুলিশ তদন্ত করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত তথ্য জানাবে। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ঘটনায় কারও মৃতু্যর খবর পাওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, কারখানাটির ছয়তলার একটি ভবনে বেলা দুইটার দিকেও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ভবনগুলোর ভেতর যাওয়া যাচ্ছে না। আগুন নিভে গেলে তারা ভবনের ভেতরে যাবেন। তখন বোঝা যাবে, কেউ পুড়ে মারা গেছেন কি না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্বৃত্তরা ছয়তলা একটি ভবনে লুটপাট করছিল। এ সময় ভবনটির নিচতলায় আগুন দেওয়া হয়। তখন কয়েকজন ভবনটির ওপরে ছিলেন। তারা বের হতে পেরেছেন কি না, সেটা তারা জানাতে পারেননি।
এদিকে সোমবার বিকালেও কারখানার আশপাশে গাজী টায়ারসহ বিভিন্ন স্থাপনায় দুর্বৃত্তদের লুটপাট করতে দেখা গেছে। প্রায় ৪৫ একর জমির ওপর স্থাপিত কারখানাটির সামনে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে কারখানার মূল অংশে লুটপাট হচ্ছে না। তবে সুবিশাল এই কারখানার চারপাশের বিভিন্ন অরক্ষিত অংশে লুটপাট চলছে। তারা কারখানা থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, স্টিল, পস্নাস্টিক ও তামা লুট করে নিয়ে যাচ্ছেন।
লুটপাটে অংশ নেওয়াদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউ কেউ এড়িয়ে গেছেন, কেউবা খেপে উঠছেন। তবে কয়েকজন লুটপাটকারী জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে এলাকার লোকজন যে যার মতো লুটপাট করেছেন। লোকজনের দেখাদেখি তারাও লুটপাটে অংশ নিয়েছেন। তবে তাদের কেউই নিজেদের নাম-পরিচয় জানাননি।
লুটপাটের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (গ-সার্কেল) হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, 'পুলিশ কোনো অবহেলা করেনি। আমরা কারখানার নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।'
লুটপাটের বিষয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, 'কারখানার লুটপাট ঠেকাতে পুলিশ, শিল্পপুলিশ, সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছে। আমি সবাইকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন আরও শক্ত অবস্থান নেন।'
এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক দৃষ্টি আকর্ষণ বিজ্ঞপ্তিতে ফায়ার সার্ভিস মিডিয়া সেল জানায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার কারখানায় আগুনে নিহত ও নিখোঁজদের তালিকা করা হয়নি।
এতে বলা হয়, গাজী টায়ারের আগুনে ফায়ার সার্ভিস নিহতের তালিকা করছে বলে কয়েকটি গণমাধ্যম তথ্য প্রকাশ করেছে। এটি সঠিক নয়। ফায়ার সার্ভিস নিহতের বা নিখোঁজের কোনো তালিকা করছে না। এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
ফায়ার সার্ভিস আরও জানায়, স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাদের ফোন নম্বর ফায়ার সার্ভিসকে দিয়ে কোনো ভিকটিম পাওয়া গেলে তাদের জানানোর অনুরোধ করেছেন মাত্র।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ঢাকা) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, 'ভিক্টিম লিস্ট তৈরির দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের। আগুন নির্বাপণ করাই আমাদের প্রথম দায়িত্ব। ভিক্টিম লিস্টের দিকে আমাদের নজর নেই। আমরা সকাল পর্যন্ত ১৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছি। তাদের স্বজনদের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছি।'
কারখানার প্রধান ফটকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তালিকা করছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সে ব্যাপারে কোনো তথ্য আমার জানা নেই। কেউ তালিকা করে থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। কেননা আমিও কিছুটা সন্দেহের মধ্যে পড়ে গেছি যে (তালিকা করার) এ তথ্যটা আপনাদের কে দিল। আমরা তো কখনো কোনো অগ্নিকান্ডের ঘটনায় কোনো তালিকা করি না।'
তবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম বিকালে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, গাজী গ্রম্নপের টায়ার তৈরির কারখানায় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনের ঘটনায় অন্তত ১৭৪ জন নিখোঁজ আছেন। সেসময় তিনি বলেছিলেন, 'স্বজনরা যারা দাবি করছেন যে, তাদের পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ রয়েছেন, যারা গতরাতে লুটপাটের সময় এই কারখানায় এসেছিলেন। আমরা তাদের একটি খসড়া তালিকা করেছি। এ মুহূর্তে তা যাচাই-বাছাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। স্বজনরা যারা দাবি করছেন তাদের নাম, ঠিকানা লিখে রাখছি।'