পিলখানায় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের মামলার আসামি বিডিআরের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহিমের কারাগারে মৃতু্যর ঘটনায় তখনকার সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা, বিডিআর প্রধান (পরবর্তীতে সেনাপ্রধান) জেনারেল আজিজ আহমেদসহ ১৩ জনের নামে হত্যা মামলার আবেদন করা হয়েছে।
আব্দুর রহিমের ছেলে অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ রোববার ঢাকার মহানগর হাকিম মো. আক্তারুজ্জামানের আদালতে এই মামলার আবেদন করেন। ঢাকার মহানগর হাকিম আক্তারুজ্জামান বাদীর জবানবন্দি শুনে অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে চকবাজার থানাকে নির্দেশ দেন।
বাদীর আইনজীবী মো. দেলোয়ার হোসেন অভি বলেন, 'বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০১০ সালের ২৯ জুলাই মৃতু্যবরণ করেন। আমরা মনে করছি, পরিকল্পিতভাবে আসামিরা তাকে হত্যা করেছেন। এ ঘটনায় তখন চকবাজার থানায় একটি অপমৃতু্যর ৫
মামলা হয়। আজ আদালত আমাদের মামলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চকবাজার থানার সেই অপমৃতু্য মামলার নথি তলব করেন। ওই অপমৃতু্য মামলায় পুলিশ আদালতে কোনো প্রতিবেদন দিয়েছিল কিনা এবং আদালত তার প্রেক্ষিতে কোনো আদেশ দিয়েছিল কিনা তা জানতে চেয়েছেন। সেটি দেখে
বিচারক মো. আক্তারুজ্জামান এ মামলাটির আবেদনের ওপর যথাযথ আদেশ দেবেন।'
অপমৃতু্য মামলার নথি উপস্থাপন ও প্রতিবেদন জমার পর বিচারক সিদ্ধান্ত দেবেন, অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হবে কিনা।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা।
বিডিআরের দরবার হল থেকে সূচনা হওয়া ওই বিদ্রোহের ইতি ঘটে নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে পরদিন। পিলখানায় বিদ্রোহের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে জওয়ানরাও বিদ্রোহ করে।
সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
মামলায় বাদী অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ বলেন, 'আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রম্নয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় সুপরিকল্পিতভাবে বিদেশি এজেন্ট নিয়োগ করে ৫৭ জন সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে। পরে বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।'
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক বিজিবি মহা-পরিচালক ও সাবেক সেনাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পিলখানা বিদ্রোহ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজলসহ ১৩ জনের নাম উলেস্নখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে মামলা আর্জিতে।
সাবেক কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম খান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সংসদ সদস্য শেখ সেলিম, নূর আলম চৌধুরী লিটন, শেখ হেলাল, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, হাসানুল হক ইনু ও ২০১০ সালের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন জেল সুপার এবং চিকিৎসক ডা. রফিকুল ইসলামের নামও রয়েছে আসামির তালিকায়।
বাদী বলেন, তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম ডিএডি হিসেবে পিলখানায় কর্মরত ছিলেন। তাকেও বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় আসামি করে আটক করা হয়। এর ৬ মাস পরে কারাগারে অন্তরীণ আসামিরা 'পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করেন।'
সাভারে হাসিনার নামে আরেকটি হত্যা মামলা
এদিকে, সাভারে গুলির পর পুলিশের সাঁজোয়া যানে তুলে সেখান থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৯ জনের নামে মামলা হয়েছে।
রোববার ঢাকার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলামের আদালতে এ মামলা করেন নিহতের মামা আব্দুলস্নাহ আল কাবির।
আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সাভার থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন।
বাদীপক্ষে মামলাটি শুনানি করেন আইনজীবী মনিরুজ্জামান মারুফ ও সাকিল আহমাদ।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুলস্নাহ আল মামুন, ঢাকার পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) আব্দুলস্নাহ হিল কাফি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) সাহিদুর রহমান, সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজামান, উপপরিদর্শক সুদীপ, হারুন অর রশিদ ও সাব্বির, সাভারের আন্দোলনে গুলি করে ভাইরাল হওয়া নড়াইলের বাবুল শরিফ (নারী পুলিশ সদস্যের স্বামী), সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজিব ও ঢাকা-১৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম।
মামলার আর্জিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এতে তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের আন্দোলনকারীদের নির্মূলের নির্দেশ দেন। আসামি ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনকারী ছাত্রদের নির্মূল করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ জুলাই পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সম্মিলিতভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে। তারা শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনকে ধরে টেনে পুলিশের সাঁজোয়া যানের কাছে নিয়ে দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে বুকের বামপাশে গুলি করে। বন্দুকের গুলিতে ইয়ামিনের বুকের বামপাশে অসংখ্য গুলির স্পিস্নন্টার বিদ্ধ হয়।
এমতাবস্থায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ইয়ামিনকে টেনে পুলিশের সাঁজোয়া যানের ওপরে ফেলে রেখে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য গাড়িটি এপাশ থেকে ওপাশ প্রদক্ষিণ করতে থাকে। ইয়ামিনকে প্রায় মৃত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেয় এবং সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে একজন পুলিশ সদস্যকে বের করে তার পায়ে পুনরায় গুলির নির্দেশ দেয়। ওই পুলিশ সদস্য ইয়ামিনকে মৃত ভেবে পায়ে গুলি না করে রাস্তার ওপরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে টেনে নিয়ে রোড ডিভাইডারের পাশে ফেলে দেয়। গুলিবিদ্ধ শাইখ ইয়ামিনকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচন্ড কষ্টে নিশ্বাস নিতে তখনও দেখা যায়। এমতাবস্থায় পুলিশ সদস্যরা ধরাধরি করে উঁচু রোড ডিভাইডারের একপাশ হতে আরেক পাশ ছুড়ে ফেলে দেয়। পরে তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
কোনো ধরনের ময়নাতদন্ত না করে এবং তৎক্ষণাৎ কোনো মৃতু্যর সনদ না দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইয়ামিনের মরদেহ হস্তান্তর করে। এ সময় হাসপাতালে উপস্থিত ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ করিলেও পুলিশ বাহিনী ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ছাত্র-জনতাকে হাসপাতাল ত্যাগে বাধ্য করে এবং ইয়ামিন এর পরিবারের দায়িত্বশীল সদস্যদের ঢাকা ও সাভার রেঞ্জের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মৃতু্য নিয়ে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে সংবাদ মাধ্যমে তথ্য দিতে বারণ এবং মামলা না করার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতিতে ইয়ামিনের পরিবার তাকে সাভার ব্যাংক টাউন কবরস্থানে দাফন করেন।
সালমান ও আলমগীরসহ
১৭৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এদিকে দোহার (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও দোহার-নবাবগঞ্জ ঢাকা-১ আসনের সাবেক এমপি সালমান এফ রহমানসহ মোট ১৭৪ জনের বিরুদ্ধে দোহার থানায় মামলা করা হয়েছে। রোববার (২৫ আগষ্ট) উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের রামনাথপুর এলাকার মো. শাহজাহান মাঝি বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্যান্য জনসাধারণ উপজেলার লটাখোলা করম আলীর মোড়সহ উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলন করেন। এ সময় মামলার প্রধান আসামি সালমান এফ রহমানের পরোক্ষ হুকুম ও দোহার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেনের প্রত্যক্ষ নির্দেশে শান্তিপূর্ণ মিছিলে আসামিরা দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে মামলার বাদীসহ বেশকিছু শিক্ষার্থীদের গুরুতর আহত করেন এবং বেশ কয়েকজন মেয়ে শিক্ষার্থীসহ আন্দোলনে অবস্থানরত সাধারণ নারীদের শ্লীলতাহানি করেন। পরে আসামিরা ওই সময় আন্দোলনকারীদের উপর ৬টি ককটেল নিক্ষেপ করলে আহত হয় অনেক সাধারণ জনগণ।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ আগস্ট ভুক্তভোগী মো. শাহজাহান মাঝি বাদী হয়ে মোট ১৭৪ জনের নাম উলেস্নখ করে ও অজ্ঞাত আরও ২০০/২৫০ জনের বিরুদ্ধে দোহার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।