২০০৩ সালে মুলতানে একদম কাছে গিয়েও পুড়তে হয়েছিল ১ উইকেটে হারের যন্ত্রণায়। সেদিন চোখে জল নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজনরা। এরপর পাকিস্তানের সঙ্গে ঘরে-বাইরে অনেকগুলো টেস্ট খেললেও জয় ছিল অধরা। ২১ বছর পর অবশেষে রাওয়ালপিন্ডিতে এলো ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সবচেয়ে কুলীন সংস্করণে প্রথমবার পাকিস্তানকে হারাল সফরকারী বাংলাদেশ দল।
রাওয়ালপিন্ডিতে রোববার নাজমুল হোসেন শান্তর দল বাংলাদেশ জিতেছে ১০ উইকেটের বড় ব্যবধানে। অথচ চতুর্থ দিন পর্যন্ত মনে হচ্ছিল এই টেস্ট এগুচ্ছে নিষ্প্রাণ ড্রয়ের দিকে। তবে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের পঞ্চম ও শেষ দিনে পেস-স্পিনের মিশেলে দুর্দান্ত বোলিংয়ে চিত্রপট বদলে দেন বাংলাদেশের বোলাররা। দলকে পাইয়ে দেন রোমাঞ্চকর ও অবিস্মরণীয় এক জয়।
ওয়ানডে ও টি২০তে পাকিস্তানকে হারালেও টেস্টে পারছিল না বাংলাদেশ। ২০০১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে লাল বলের ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচ খেলে, তার পর দেশে ও বাইরে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ১৩ বার। তার মধ্যে ১২টিতেই হার বাংলাদেশের, অন্যটি ড্র। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৩ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে রোববার ১০ উইকেটের ঐতিহাসিক টেস্ট জয় তুলে নিয়েছে টাইগাররা।
সিরিজের প্রথম টেস্টের লক্ষ্যটা ছিল খুবই ছোট। সময়ের হিসাবেও বাকি ছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টা, উইকেটও হাতে ১০টি। এতসব রসদ নিয়ে বাংলাদেশকে করতে হবে মাত্র ৩০ রান। এই রানটা সহজেই তুলে নেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার সাদমান ইসলাম ও জাকির হাসান। ঐতিহাসিক জয়ের অপেক্ষায় থাকা ক্রিকেটাররা ড্রেসিংরুমের সামনেই বসেছিলেন। জাকির চার মারতেই সবার আগে লাফিয়ে উঠেন তরুণ ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয়।
ইনজুরিতে না পড়লে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে জাকিরের জায়গাতে তিনিই থাকতেন। এরপর সাকিব-শান্ত-মুশফিকরা দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়টি উদযাপন করেছেন। সাকিবতো দুই হাত উঁচিয়ে দেখান উচ্ছ্বাস। হবেই না কেন, ২৩ বছরের অপেক্ষার অবসান বলে কথা। যদিও বাংলাদেশ ২০০৩ সালেই পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের সাক্ষী হতে পারত। কিন্তু ইনজামামের দৃঢ়তায় ১ উইকেটে তারা টেস্টটি হেরে গেছে। ওই টেস্টের কেউই এখন আর খেলছেন না। যখন ওই টেস্ট হচ্ছিল, সাকিব-মুশফিকদের কারো অভিষেকই হয়নি।
মুলতান টেস্টের মতো আরও অনেক হারের সঙ্গী বাংলাদেশ দল। এবার অবশ্য তাদের আর ভুল হয়নি। দেশের মানুষকেও আর অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। দারুণ ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং উপহার দিয়ে দলকে ঐতিহাসিক এক জয় এনে দিয়েছেন মুশফিক-সাকিব-মিরাজ-সাদমানরা।
সফরকারীরা চতুর্থ দিন
শেষ বিকালেই জয়ের সুবাস পাচ্ছিল। ১১৭ রানের পিছিয়ে থেকে পাকিস্তান দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামে। শেষ বিকালে এক উইকেট হারিয়ে তারা চাপে পড়ে যায়। রোববার সকালে নেমে বাংলাদেশের স্পিনারদের ঘুর্ণিজাদুতে একে একে ব্যাটসম্যানরা কোণঠাসা হয়ে পড়লে ইনিংস ব্যবধানে হারের শঙ্কাও জাগে। শেষ পর্যন্ত রিজওয়ানের দায়িত্বশীল ইনিংসে কোনোমতে সেটা এড়িয়ে বাংলাদেশেকে ৩০ রানের লক্ষে বেঁধে দিতে পারে স্বাগতিক দল। পাকিস্তানের হয়ে শফিক ৩৭ ও রিজওয়ান ৫১ রানের ইনিংস খেলেছেন।
পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংস মাত্র ১৪৬ রানে গুটিয়ে আনেন স্রেফ ৩০ রানের লক্ষ্য। সেটা পেরুতে ৬.৩ ওভারের বেশি খেলা লাগেনি। দেশের বাইরে টেস্টে এটি বাংলাদেশের সপ্তম জয়। মাউন্ট মাঙ্গানুইতে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর এই জয়কেই নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে বড় করে রাখতে হয়।
বাংলাদেশের জেতার ভিত তৈরিতে বড় ভূমিকা অবশ্য ব্যাটসম্যানদের। স্বাগতিকদের ৪৪৮ রানের জবাবে ৫৬৫ রান তুলে ১১৭ রানের লিড নিয়ে চমকে দেয় শান্তর দল। অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম খেলেন ১৯১ রানের ইনিংস। ওপেনার সাদমান ইসলামের ব্যাট থেকে আসে ৯৩ রান।
মেহেদী হাসান মিরাজ ব্যাটিংয়ে ৭৭ রানের পর বোলিংয়েও ৪ উইকেট নিয়ে রাখেন বড় ভূমিকা। উইকেটের পেছনে ৬টি ডিসমিসালের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে ফিফটি করেন লিটন দাস, ফিফটি আসে মুমিনুল হকের ব্যাট থেকেও। নতুন বলে শরিফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদরা দুই ইনিংসেই রাখেন ঝাঁজালো ভূমিকা। অর্থাৎ সম্মিলিত পারফরম্যান্সেই ডানা মেলে ধরে বাংলাদেশ।
এই টেস্টের প্রথমদিনের বেশিরভাগটা ভেসে গিয়েছিল বাজে আবহাওয়ায়। এরপর ব্যাট করতে নেমে শুরুর বিপর্যয় কাটিয়েও বড় রানের দিকে ছুটছিল পাকিস্তান। দ্বিতীয় দিন বিকালে ৬ উইকেটে ৪৪৮ রান তুলে ইনিংস ছেড়ে দেয় তারা। বাংলাদেশও দিতে থাকে জোরাল জবাব। নিবেদন, চেষ্টা, চোয়ালবদ্ধ দৃঢ়তায় ইনিংস টেনে নিতে থাকেন ব্যাটাররা। পাকিস্তানের পুঁজি ছাপিয়ে অনেক দূর চলে যায় বাংলাদেশ।
চতুর্থ দিন বিকালে এসে বড় লিড নেওয়ার পরই পরিষ্কার হয়ে যায় আর যাইহোক এই টেস্টে হারছে না বাংলাদেশ। তবে জেতার আশা তখনো ছিল বাড়াবাড়ি। চতুর্থ দিন শেষে ১ উইকেটে ২৩ তুলেছিল পাকিস্তান। তখনো ড্র-ই ছিল সম্ভাব্য ফলাফল। তবে পঞ্চম দিনে হিসেব বদলে দিতে থাকে বাংলাদেশ। সকালেই দারণ বল করে হাসান মাহমুদ কাবু করেন শান মাসুদকে। বাবর আজম শূন্য রানে জীবন পেলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি।
নাহিদ রানা তাকে থামান গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। এরপরই স্পিন ভেল্কি শুরু সাকিব-মিরাজের। রাজনৈতিক পালাবদলের পর দেশে সাকিবের বিরুদ্ধে হয়েছে হত্যা মামলা, তাকে জাতীয় দল থেকে বাদ দেওয়ার উকিল নোটিসও দেওয়া হয়েছে বিসিবিকে। এসব চাপ একদম নিজের উপর পড়তে দেননি বাংলাদেশের সফলতম ক্রিকেটার।
সাউদ শাকিল, আব্দুলস্নাহ শফিকের মহাগুরুত্বপূর্ণ দুই উইকেট নিয়ে দলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেন তিনি। পরে নাসিম শাহকে আউট করে ধরেন তৃতীয় শিকার। মিরাজ ব্যাট হাতে ঝলক দেখানোর পর নিজের আসল কাজেও ছিলেন পটু। শেষ দিনের উইকেট ভেঙে যাওয়ায় তা থেকে মিলে টার্ন, বাউন্স। কিছু বল নিচুও হচ্ছিল। সব মিলিয়ে মিরাজ হয়ে উঠে দুর্ধর্ষ। ৪ উইকেট তুলে নেন তিনি।
২১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার অফ স্পিনার মিরাজের। এছাড়া ৪৪ রানে তিনটি উইকেট শিকার করেছেন সাকিব। এই তিন উইকেটে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন ড্যানিয়েল ভেট্টরিকে। টেস্ট ক্রিকেটে বাঁ হাতি স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক এখন তিনি।
বাংলাদেশের বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪৬ রান সংগ্রহ করতে পারে পাকিস্তান। তাতে লিডও দাঁড়ায় মাত্র ২৯ রানের। ৩০ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে বাংলাদেশ সপ্তম ওভারেই বিনা উইকেটে জয় নিশ্চিত করে। জাকির হাসান ১৫ এবং সাদমান ইসলাম ৯ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
পাকিস্তান প্রথম ইনিংস: ৪৪৮/৬ (ডি.)
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ৫৬৫
পাকিস্তান দ্বিতীয় ইনিংস: (আগের দিন ২৩/১) ৫৫.৫ ওভারে ১৪৬ (শাফিক ৩৭, মাসুদ ১৪, বাবর ২২, শাকিল ০, রিজওয়ান ৫১, সালমান ০, আফ্রিদি ২, নাসিম ৩, শাহজাদ ৫*, আলি ০; শরিফুল ১/২০, হাসান ১/২০, সাকিব ৩/৪৪, নাহিদ ১/৩০, মিরাজ ৪/২১)।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস: (লক্ষ্য ৩০) ৬.৩ ওভা ৩০/০ (জাকির ১৫*, সাদমান ৯*; আফ্রিদি ০/৮, নাসিম ০/৭, সালমান ০/৯)।
ফল: বাংলাদেশ ১০ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: দুই ম্যাচ সিরিজে ১-০তে এগিয়ে বাংলাদেশ।
ম্যাচসেরা : মুশফিকুর রহিম।