ত্রাণের জন্য হাহাকার
বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের তীব্র সংকট, এখনো পানিবন্দি অর্ধকোটি মানুষ
প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
বন্যাকবলিত ১৩ জেলার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে গোটা দেশ। সরকারি ত্রাণের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যার্তদের সহায়তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় মানুষের দেওয়া শুকনা খাদ্যসহ নানা ত্রাণসামগ্রীর পাহাড় জমেছে। প্রতিদিন বিলিও হচ্ছে শত শত টন। অথচ বন্যা দুর্গত দুর্গম এলাকার লাখো মানুষ দুই-তিন দিন ধরে অভুক্ত দিন কাটাচ্ছেন। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ওষ্ঠাগত তাদের প্রাণ। এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ সংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোববার বিকাল ৩টা পর্যন্ত বন্যায় এখনো দেশের ১১টি জেলায় ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫২ লাখ ৯ হাজার ৭৯৮। এখন পর্যন্ত বন্যায় ১৮ জনের মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। নিখোঁজ আছেন দুজন। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চট্টগ্রামে পাঁচজন, কুমিলস্নায় চার, নোয়াখালীতে তিন, কক্সবাজারে তিন, ফেনীতে এক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক ও লক্ষ্ণীপুরে একজন। এ ছাড়া নিখোঁজ দুজন মৌলভীবাজারের। প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলাগুলোতে ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন ৪ লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। উদ্ধার কার্যক্রমের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। বন্যা পরিস্থিতিতে সারাদেশের ১০টি জেলায় মোট ৮ লাখ ৩১ হাজার ৯৮ জন গ্রাহক বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন। বিচ্ছিন্ন হওয়া এলাকায় পুনরায় সংযোগ দিতে বিদু্যৎ বিভাগ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। রোববার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ডের সদস্য (পরিচালন ও বিতরণ) দেবাশীষ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, 'আমরা সাব স্টেশন এবং মোবাইল টাওয়ারগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চালু করছি। যেন মোবাইল টাওয়ারে বিদু্যৎ সংযোগ দেওয়া যায়। পর্যায়ক্রমে মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করে আমরা বিদু্যৎ সংযোগ দিচ্ছি।' এদিকে বানভাসি দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, বেশিরভাগ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি। বিশেষ করে ফেনী, কুমিলস্না, নোয়াখালী ও লক্ষ্ণীপুরসহ বন্যাকবলিত অন্তত ৮ জেলার দুর্গম এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। কেউ কেউ দূরে গিয়ে সামান্য শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি জোগাড় করে আনতে যেয়ে জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। অথচ এসব এলাকায় সামর্থ্যবান নারী-পুরুষ ছাড়াও হাজার হাজার শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধ মানুষ রয়েছে। তাদের একটি বড় অংশ না খেতে পেয়ে মৃতু্যর প্রহর গুনছে। স্থানীয়রা বলছেন, নৌকাসহ অন্যান্য জলযান সংকটে ত্রাণ দিতে আসা লোকজন প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে পারছেন না। সড়কের পাশে যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের মধ্যেই বারবার ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এতে অনেকের ঘরে এক দেড় সপ্তাহের খাদ্য জোগাড় হলেও দুর্গম এলাকার বানভাসিরা এক মুঠো খাবারের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন। বন্যা পরিস্থিতি ও ত্রাণ বিতরণ পর্যবেক্ষণকারীদের ভাষ্য, সরকারি ত্রাণ কিছুটা নিয়মমাফিক বিতরণ করা হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত ত্রাণসামগ্রী শুরু থেকেই অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে বিলি করা হচ্ছে। সুষ্ঠু সমন্বয় ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা না থাকায় কেউ কেউ একাধিকবার ত্রাণ পেলেও অনেকে তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কৌশলী ছক না থাকায় বন্যা দুর্গত দুর্গম এলাকার পানিবন্দি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ত্রাণ পর্যবেক্ষণকারীরা বলছেন, অনেকেই অল্প কিছু ফান্ড বা ত্রাণ সংগ্রহ করে বন্যাদুর্গত এলাকায় যাচ্ছেন। এতে বন্যার্তদের সাহায্যের একটি বড় অংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ট্রান্সপোর্টে বা অন্যান্যভাবে। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকরা কৌশলী হলে সব ফান্ড এবং ত্রাণ যথাযথভাবে কাজে লাগানো যেত। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যে বা যারা ত্রাণ সংগ্রহ করছে তাদের একটি কাঠামোগত অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। যেহেতু এই বন্যার প্রভাব সামনে আরো অনেক দিন থাকবে সেহেতু এ বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা জরুরি। তা না হলে দুর্গম এলাকার বানভাসিরা ভয়াবহ বিপাকে পড়বেন। এদিকে ত্রাণ নিয়ে বন্যাকবলিত এলাকায় ছুটে যাওয়া মানুষও তাদের অসহায়ত্বের কথা নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। ঢাকার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক সদস্য জানান, তারা দুই ট্রাক শুকনা খাবার নিয়ে নোয়াখালী গিয়েছিলেন। দুর্গম এলাকায় আটকে থাকা পানিবন্দি মানুষের কাছে এ ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তারা সেখানে যেতে পারেননি। সেখানে যাওয়ার জন্য ট্রলার ও নৌকা ভাড়া করার চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়েছেন। পরে বাধ্য হয়ে তারা সামনে যাকে পেয়েছেন তাদের মাঝেই ত্রাণ বিলি করেছেন। তাদের মতো অনেকেরই দুর্গম এলাকায় ত্রাণ দেওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে বলে জানান তিনি। দুর্গম ফুলগাজীর মুন্সীরহাট এলাকা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দু'মুঠো খাবার জোগাড় করতে ফেনীতে আসা যুবক নূরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সেখানকার মানুষ না খেয়ে আছে। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে ভুগছে। নিরুপায় হয়ে অনেকে দূষিত পানি পান করছেন। এতে সেখানে পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ সেখানে কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। অথচ রোববার ফেনীর বিভিন্ন এলাকা দফায় দফায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষ সড়কের পাশে বেশি ত্রাণ দিচ্ছেন। অনেকে একই ধরনের খাদ্যসামগ্রী দুই-তিন দফা পাচ্ছেন। ত্রাণ দিতে আসা স্বেচ্ছাসেবকরা অক্ষমতার কথা স্বীকার করে জানান, ঢাকা বা আশপাশে থেকে যারা নৌকা নিয়ে এসেছেন তারা নিজেদের মতো করে দুর্গত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ দিতে পেরেছেন। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। কুমিলস্নার স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া কুমিলস্না জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলা পানিতে নিমজ্জিত। প্রতিদিনই পস্নাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। চারদিকে বানভাসি মানুষের হাহাকারের মধ্যে দেখা দিয়েছে ত্রাণ ও সুপেয় পানির সংকট। কুমিলস্নায় আকস্মিক বন্যায় সবার প্রথমে পস্নাবিত হয় জেলার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ ও লাকসাম উপজেলা। গত বৃহস্পতিবার রাতে গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পস্নাবিত হয় বুড়িচংসহ অন্যান্য উপজেলা। এসব উপজেলার মধ্যে সারাদেশ থেকে উদ্ধার কর্মী ও ত্রাণ বেশি প্রবেশ করেছে দাউদকান্দি, বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া এলাকায়। অন্যদিকে ত্রাণ পাচ্ছেন না নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষ। বানভাসিরা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই দুই উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্র এবং কয়েকটি স্থানে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব ত্রাণে বন্যাকবলিতদের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। ফলে এ দুই উপজেলার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রচার কম থাকায়, ব্যক্তি ও সংগঠনকেন্দ্রিক ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ করা বাইরের স্বেচ্ছাসেবকরা একদম আসছেন না এ দুই উপজেলায় বলে জানান তারা। মনোহরগঞ্জ উপজেলার গাজিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর জানান, বুড়িচংসহ অন্যান্য উপজেলার আগে মনোহরগঞ্জ উপজেলা পুরোপুরি পস্নাবিত হয়। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে আলোচনায় আসেনি। এই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে সরকারি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে এখনো কোনো ত্রাণ পৌঁছায়নি। খাবারের কষ্টে মানুষ হাহাকার করছেন। আবুল কালাম আজাদ নামে মনোহরগঞ্জ উপজেলার এক মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, 'এ উপজেলা আগে থেকেই পরিচিত জলাঞ্চল নামে। জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে এ উপজেলা নিম্নাঞ্চল হওয়ায় পানিতে মানুষ খুবই কষ্ট পাচ্ছেন। পানিবন্দি বানভাসিদের উদ্ধার করতে নৌকা ও স্পিডবোট দরকার। কিন্তু এখানে তেমন কোনো সহায়তা এখনো আসেনি। মানুষ কষ্টে আছেন।' রোববার মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা জানান, তার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত অবনতির দিকে যাচ্ছে। পানি কিছুটা বেড়েছে। মনোহরগঞ্জ উপজেলার অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে যেগুলোতে নৌকা ছাড়া যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে নৌকার যথেষ্ট সংকট রয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পাঠিয়ে সেসব এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন একটা মানুষও অভুক্ত না থাকে। তবে আমাদের আরও অনেক সহায়তা দরকার।' এদিকে লাঙ্গলকোটের বাসিন্দা আজিম উল্যাহ হানিফ বলেন, এ উপজেলার সাতবাড়িয়া গত কয়েক দিন ধরে পানির নিচে। এলাকাটা অনেক ভেতরে হওয়ায় কেউই সেখানে যাচ্ছেন না। যার কারণে তাদের খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থা পুরো উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোতে। উপজেলার ঢালুয়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পুরো নাঙ্গলকোটে শুধু পানি আর পানি। অনেক অসুস্থ মানুষ, বৃদ্ধ মানুষ, গর্ভবতী নারীও আটকে আছেন। তাদের উদ্ধার করা খুব দরকার, পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তাও। নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আক্তার লাকী বলেন, 'এ উপজেলায় ত্রাণ সরবরাহে কিছুটা সংকট আছে আমরা সেটা স্বীকার করছি। কিছু জায়গায় একেবারেই পৌঁছানো যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে তাদের কাছে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার। আমরা চেষ্টা করছি সকল মানুষকে সহায়তা দেওয়ার।' এদিকে ফেনীর দুর্গম এলাকায়ও ত্রাণের হাহাকারের খবর পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ফেনীতে উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ডের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীরাও পৌঁছেছেন। তবে সেখানে সমন্বয়ের অভাবে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বেশকিছু জায়গায় এখন উদ্ধার কাজের জন্য পৌঁছানো যায়নি, ত্রাণও পৌঁছেনি।' স্থানীয় প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, সেখানে সমন্বয়ের একটি বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে। ঢাকা বা দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে যারা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সেখানে গেছে, তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। যারা বাইরে থেকে এসেছে, তারা একটা পরিকল্পনামাফিক কাজের চেষ্টা করছে আর স্থানীয়রা তাদের আপন মানুষদের জন্য কাজ করতে চাচ্ছেন। এর ফলে যাদের সাহায্য পাওয়া জরুরি তারা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতে থাকায় জেলা প্রশাসন তাদের পরিকল্পনামাফিক করতে পারছে না। এতে করে সঠিক সময়ে উদ্ধারকাজও চালানো যাচ্ছে না। ফেনীর বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন বেসরকারি সংস্থা আল খায়ের ফাউন্ডেশেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর তারেক মাহমুদ সজীব। তিনি জানান, 'দুর্গম এলাকায় গিয়ে দেখেছি, হাজার হাজার মানুষ এখনো অনেক বাড়ির ছাদে গরু-ছাগলের সঙ্গে অবস্থান করছেন। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত যেখানেই গেছি- মানুষের আর্তচিৎকার, হাহাকার শুনেছি। তারা তাদের ঠিকানা ছাড়তে চাচ্ছেন না। কিন্তু তাদের অবস্থা শোচনীয়। তাদের জন্য শুকনা খাবার দরকার, বাচ্চাদের খাবার দরকার, খাবার পানি দরকার, স্যানিটারি ন্যাপকিন দরকার।' শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ত্রাণ বিতরণ চলছে। বেশিরভাগই দুর্গম এলাকায় পৌঁছাচ্ছে না। অনেক জায়গায় স্পিডবোট নিয়েও এখন যাওয়া যাচ্ছে না- জানান তিনি। যায়যায়দিনের স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার জানান, মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা, মনু, ধলাই ও জুড়ী নদের পানি কমলেও দুশ্চিন্তা এখনো কাটেনি। বৈরী আবহাওয়া ও লাগার বৃষ্টি ও ভারতের ঢলে আবারও পানি বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন নদ-নদীর পাড়ের বাসিন্দারা। এদিকে জেলার কাউয়াদিঘী হাওড়ে মনুর পানি ঢুকে যাওয়ায় রুপা আমনসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে যানা গেছে। রোববার বিকালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়মিত বুলেটিনে জানায়, মৌলভীবাজার শহর দিয়ে ঘেঁষে যাওয়া মনু নদের চাঁদনীঘাট সেতুতে পানি বিপৎসীমার ২ সেমি ওপর দিয়ে, মনু নদের রেলওয়ে সেতুতে বিপৎসীমার ২৩৫ সেমি নিচ দিয়ে, ধলাই নদে বিপৎসীমার ২৯০ সেমি নিচ দিয়ে, কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেমি ওপর দিয়ে ও জুড়ী নদে ১৬৪ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে মনু নদের রাজনগর উপজেলার কদমহাটায় প্রায় ১ সপ্তাহ আগে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পাশের কাউয়াদিঘী হাওড়ের রুপা আমন ধান তলিয়ে গেছে। পস্নাবিত হয়েছে রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বাজারগুলোতে বন্যার প্রভাবে ও সরবরাহ কমে শুকনা খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। উপজেলার কোনো বাজারে দু'দিন আগে থেকে চিড়া, মুড়ি ও গুড় পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে সবজি থাকলেও বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। এছাড়া আলু, পেঁয়াজ কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শুকনা খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দাম। টাকা দিয়েও চিড়া, মুড়ি ও গুড় না পাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এক রাতের ব্যবধানে চিড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিপ্রতি প্রায় ৩০ টাকা। মুড়ির দামও বাড়ানো হয়েছে। ৭০ টাকার মুড়ি রাতের মধ্যে হয়ে গেছে ৮০ টাকা। একশ টাকার নিচে মিলছে না তরকারি। সরবরাহ না থাকায় বাড়ছে বিভিন্ন জিনিসের দাম। বানভাসি মানুষকে পুঁজি করে ব্যবসা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। মিরসরাই পৌর সদরের ব্যবসায়ী জানে আলম বলেন, 'দোকানে যা ছিল প্রথম দিনেই শেষ। এরপর যানজটের কারণে পণ্য আসা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা ফেনী থেকে মালামাল নিয়ে আসি কিন্তু সেখানে বন্যা হওয়ায় দোকান খুলতে পারিনি। অর্ডার দিয়েও মাল আসছে না।' এদিকে টানা ভারী বর্ষণে লক্ষ্ণীপুরের সর্বত্র জলাবদ্ধতায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে পানি কমতেও শুরু করেছিল জেলা শহরসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোতে। কিন্তু শুক্রবার থেকে নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালীসহ খালসহ বিভিন্নভাবে ঢুকছে লক্ষ্ণীপুরে। এতে লক্ষ্ণীপুর পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড ও পূর্বাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোর অধিকাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানিবন্দি এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্ণীপুরের ১টি পৌরসভা ও ৪৫টি ইউনিয়ন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এতদিন বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে ছিল। গত দুই দিন ধরে নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্ণীপুরে ঢুকে পড়ছে। এতে সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, বাঙ্গাখাঁ, উত্তর জয়পুর ইউনিয়নসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় ৪ ফুট পানিতে ডুবে আছে জনপদ। রামগতি ও কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা-হাজীগঞ্জ বেড়ির পশ্চিম পাশে ভুলুয়া নদীতে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে প্রায় ২৫ দিন ধরে পানিতে ডুবে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ। রামগতি-কমলনগর ও নোয়াখালীর আন্ডারচর ও চরমটুয়া গ্রামের ৩ লক্ষাধিক মানুষ এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। জলাবদ্ধতার এ পানি কোথাও সরছে না। সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের কারণে এখন পর্যন্ত লক্ষ্ণীপুর জেলায় ৬ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৯৫ টন চাল ও ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্ণীপুরে পানিবন্দি মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৮৯টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তত করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে মানুষজন আশ্রয় নিয়েছে। সবাইকে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। যায়যায়দিনের হবিগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, উজানের ঢলে গত বুধবার খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ২৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে স্মরণকালের সর্বোচ্চ আগ্রাসী রূপ ধারণ করে। নদীর বাঁধ উপচে হবিগঞ্জ শহর ও হাওড়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। শঙ্কা দেখা দেয় শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ারও। শহরবাসী তিন দিন আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় কাটানোর পর অবশেষে রোববার পানি বিপৎসীমা থেকে নিচে নামার খবর দিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে জেলাজুড়ে স্বস্তি ফিরেছে। সম্প্রতি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে হবিগঞ্জে বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। গত বুধবার জেলায় ৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি ঢলও অব্যাহত থাকে। ফলে বাড়তে থাকে খোয়াই নদীর পানি। বুধবার চুনারুঘাটের বালস্না পয়েন্টে নদীতে পানির উচ্চতা মাপা হয়েছিল ২৩ দশমিক ৭৪ মিটার। যা বিপৎসীমা থেকে ২৭৭ সেন্টিমিটার ওপরে এবং গত তিন যুগ অর্থাৎ ৩৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জেলা শহরের আরও দুটি পয়েন্টে ও শায়েস্তাগঞ্জ পয়েন্টেও একইভাবে পানি বিপৎসীমার ওপরে ছিল। আর কিছু পানি বাড়লে হবিগঞ্জ শহরে বড়রকম বন্যা দেখা দিত। এদিকে, পানি বাড়তে থাকায় হবিগঞ্জ শহরের আশপাশে অন্তত ১৩টি স্থান দিয়ে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। শহরবাসীর মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়। লোকজন রাত জেগে পাহাড়া ও স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত কাজ চালান। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাবিবুর রেজা যায়যায়দিনকে বলেন, '১৯৮৮ সালে খোয়াই নদীতে পানির উচ্চতা ২৫.৭৪ মিটার হয়েছিল। এরপর অনেকবার পানি বাড়লেও এতটা বাড়েনি। তিন যুগ পর এবার নদীর পানি এতটা বিপৎসীমার উপরে উঠেছে।' তিনি আরও বলেন, 'আর হাফ মিটার (অর্ধমিটার) পানি বাড়লে বাঁধ উপচে শহরে পানি প্রবেশ করতো। এ পরিস্থিতিতে হবিগঞ্জ শহর তলিয়ে যাওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল না।' চট্টগ্রাম বু্যরো অফিস জানায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম ও নাজিরহাট রুটে লোকাল ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে এখনো বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার সঙ্গে ট্রেন চলাচল। ফেনী থেকে হাসানপুর পর্যন্ত রেললাইন এখনো পানির নিচে ডুবে থাকায় ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রোববার সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছেড়ে যায়। একই সময় বিদু্যৎ কেন্দ্রের জন্য জ্বালানিবাহী একটি ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে দোহাজারীর উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। এছাড়া সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে লোকাল ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে এবং সন্ধ্যা ৭টায় কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন ছেড়ে আসে। রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সাইফুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ায় লোকাল ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে ফেনী থেকে হাসানপুর পর্যন্ত রেললাইন এখনো পানির নিচে ডুবে থাকায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাসহ অন্য রুটের ট্রেন চলাচল এখনো বন্ধ রয়েছে। এছাড়া শনিবারের মতো রোববারও উদ্ধারকারী ট্রেন গিয়েছে। উলেস্নখ্য, গত বৃহস্পতিবার ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দুপুর ১২টার পর থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, জামালপুর, সিলেট, কক্সবাজার ও চাঁদপুরে প্রতিদিন ১১টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের নাজিরহাট, কক্সবাজার, চাঁদপুর, ঢাকা ও ময়মনসিংহে লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চলাচল করে নিয়মিত। এদিকে বন্যায় নতুন করে কোনো এলাকা পস্নাবিত হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান। রোববার দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। সচিব বলেন, সার্বিকভাবে ১১ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। নতুন করে কোনো এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে না এবং হওয়ার আশঙ্কা নেই। মো. কামরুল হাসান বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১১ জেলায় মোট ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা ও অন্যান্য খাবার, ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গোখাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে। বন্যা উপদ্রম্নত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে বলেও জানান তিনি। সচিব বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একসঙ্গে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মো. কামরুল হাসান বলেন, ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ ও সড়ক পথে এবং তাদের হেলিকপ্টারসহ বিমানবাহিনী, র?্যাব ও বিজিবির হেলিকপ্টারযোগে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রম চলমান আছে। সচিব বলেন, ফেনীতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা নির্দেশনা দিচ্ছেন।