পরিবহণসহ বিভিন্ন স্তরে চাঁদাবাজি বন্ধ হলেও চালের বাজারে এর সুফল মেলেনি। বরং বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দাম সহনীয় রাখতে সরকার ও শিক্ষার্থীদের জোরালো তৎপরতার মধ্যেই দাম আরও এক ধাপ বেড়েছে। অথচ দেশে চালের সরবরাহ ও মজুত স্বাভাবিক রয়েছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল তা বেশ আগেই কেটে গেছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, নানা অজুহাত ও অপকৌশলে অযৌক্তিক দামে পণ্য সরবরাহ করছে গুটিকয়েক করপোরেট প্রতিষ্ঠান। যে কারণে চালের দাম বাড়তির দিকে। এ নেপথ্যে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে। দ্রম্নত সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া না গেলে চালের বাজার আরও অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সংস্কারের দাবিতে প্রায় এক মাস ধরে চলা আন্দোলনে দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। উৎপাদনে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। ফলশ্রম্নতিতে, মিলগেট-পাইকার থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ে বেড়ে যায় চালের দাম।
অথচ পরিস্থিতি বেশ আগেই স্বাভাবিক হলেও, এখনো দাম কমার আভাস নেই। বরং নানা অজুহাতে দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। খুচরা বাজারে, কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে শুরু চালের দাম। মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ২ থেকে ৩ টাকা। মোটা চালের দাম কেজিতে এক থেকে দেড় টাকা বেড়েছে।
পাইকারি বিক্রেতাদের অভিযোগ, ধানের বাম্পার উৎপাদন ও চালের সন্তোষজনক মজুত থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ার নেপথ্যে পুরানো সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আনুকূল্যে থাকা ১০-১২টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে এখনো জিম্মি চালের বাজার। প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা।
তবে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকের তারল্য সংকটকে দায়ী করছেন মিলাররা। তাদের ভাষ্য, ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পাওয়ায়, ধান কিনতে পারছে না তারা। এর নেতিবাচক
প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-এর (টিসিবি) তথ্য বলছে, চালের বর্তমান দর গত বছরের এই সময়ের তুলনায়ও বেশি। গত এক বছরের ব্যবধানে দেশের বাজারে মোটা চাল ৯.১৮ শতাংশ, মাঝারি মানের চাল ৭.৪৮ শতাংশ ও সরু চাল ৪.৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। সারা দেশে স্বল্প মূল্যে খোলা বাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া, সরকারের গুদামেও চালের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। বর্তমানে সরকারের গুদামে মোট ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ৮১৪ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে চাল মজুত রয়েছে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৪৬ টন। আর গমের মজুত ৪ লাখ ২০ হাজার ৪০১ টন।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে এখন সব ধরনের নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সরবরাহ সমস্যায় বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। বর্তমানে কোনো কোনো পণ্যের দাম কমলেও চালসহ কিছু পণ্যের দাম এখনো বাড়তি। এসব পণ্যের মিলার ও পাইকারি পর্যায়ে তদারকি করলে দাম কমে আসবে। নিত্যপণ্যের বাজারে যে সিন্ডিকেট হয় তা মিলার ও পাইকারি পর্যায়েই হয়ে থাকে। তাই এখানে সিন্ডিকেট ভাঙতে পাড়লে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
রাজধানীতে চালের সবচেয়ে বড় পাইকারিবাজার বাবুবাজার বাদামতলী। বাবুবাজার চাল আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি নিজামউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যবসায় বেচা-কেনার গতি অনেক কম। অনেকের কাছে আগে থেকে যে চাল ছিল, তাই বিক্রি করছে। এখনো অনেকে নতুন মাল উঠায়নি। এসব কারণে দাম একটু বেড়েছে। তবে এখনো চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে চালের বাজার স্থিতিশীল হবে বলে আশা করেন তিনি।
কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, এক মাস ধরে বাড়ছে চালের দাম। প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। মিলাররা ধান সংকটের অজুহাত দিচ্ছেন। উৎপাদন এলাকার মিল পর্যায়ে ধান-চালের মজুতের পরিমাণ তদারকি করলে আসল চিত্র বের হবে। সরকারের উচিত এখনই তদারকি বাড়ানো।
অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, প্রতি বছর এ সময় ধান-চালের দর একটু বেশি থাকে। কারণ এখন ধানের মৌসুম নয়। ধানের মজুত কমে এসেছে। তাই যারা মজুত করছেন, তারা কিছুটা বেশি দরে ধান বিক্রি করছেন। দুই মাস পর আমন উঠলে কেজিতে অন্তত ৫ টাকা কমে যাবে।
শুক্রবার মালিবাগ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে সরু চাল গত সপ্তাহে বাড়তি দরে সর্বনিম্ন ৬০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বেড়ে ৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সর্বনিম্ন দরে মাঝারি মানের চাল পাইজাম-লতা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং মোটা চাল ইরি-স্বর্ণা ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা সপ্তাহের ব্যবধানে চালের মানভেদে কেজিতে এক থেকে চার টাকা বেশি।
এ বাজারে চাল কিনতে আসা বদিউল আলম নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, 'ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখি সবকিছুর দাম কম। তবে বাজার আসলে বোঝা যায়, প্রকৃত অবস্থা কোনটি। চালের সরবরাহ স্বাভাবিক, পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ, সিন্ডিকেটও নেই। তাহলে চালের দাম হু হু করে বাড়ছে কীভাবে?' এক সপ্তাহ আগে ৭২ টাকা দরে যে কাটারিভোগ চাল কিনেছেন, তা এখন ৭৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে- অভিযোগ করেন বদিউল আলম।
মালিবাগ বাজারের চাল বিক্রেতা আবুল কাশেম চালের দাম কিছুটা বাড়ার কথা নিঃসংকোচে স্বীকার করেন। তার ভাষ্য, 'চাল বিক্রির গতি কম। অনেকের কাছে আগে থেকে যে চাল ছিল, তাই বিক্রি করছে। এখনো কেউ কেউ নতুন দামে চাল উঠায়নি। তাই দাম কিছুটা বাড়তি।'
সরবরাহ নিয়ে জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী জানান, চালের দাম কিছুটা বেড়েছে ১৮ আগস্ট থেকে। এরপর আর বাড়েনি। এখন চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। ৫/৭ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হবে।
এদিকে খুচরা বিক্রেতারা দাম বৃদ্ধির জন্য পাইকারি ব্যবসায়ীদের দায়ী করলেও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৭ থেকে ১০ দিন অগে দাম কিছুটা বাড়তি থাকলেও সেটা এখন কমতে শুরু করেছে। ব্যাংক লেনেদেন সীমাবদ্ধ হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে নগদ টাকার লেনদেন করতে না পেরে চালের সরবরাহ কমে যাওয়াকে দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
যদিও ব্যাংক থেকে ৩ লাখ টাকার বেশি তুলতে না পারলেও ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো বাধা নেই।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চালের আড়তদার জাহিদুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি চালের দাম বাড়তি থাকলেও সেটা আবার কমতে শুরু করেছে। তিনি অবশ্য কর্পোরেট বিক্রেতা ও মিল মালিকদের পর্যায়ে মনিটরিং বাড়ানোর দাবি তুলেছেন।
তবে নওগাঁর ধান চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা দাবি করেন, মিলগেটে চালের দাম বাড়েনি। ঢাকার যেসব পাইকারি বাজার আছে, সেখানে মনিটরিং করলে দাম কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, '১৫ টনের একটি গাড়িতে ১০ লাখ টাকার বেশি চাল থাকে। কিন্তু ব্যাংক থেকে ৩ লাখ টাকার বেশি তুলতে না পেরে অনেকেই টাকা পাঠাতে পারছেন না। যে কারণে চালের সরবরাহেও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।'
কুষ্টিয়ার মা ভান্ডারী অটো রাইস মিলের মালিক ও রাইস মিল মালিকদের সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাসুদ রানা জানান, চালের দাম বেড়েছে ধানের দাম বৃদ্ধির কারণে। শুকনো ধানের প্রকারভেদে মণপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। তার ভাষ্য, 'এবারে মিল মালিকরা ধান মজুত করেনি। নিয়মিত বাজার থেকে কিনছে। এ কারণে দামটাও বেশি।'
কৃষি বিভাগ বলছে, গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে বোরো মৌসুমের চাল উঠতে শুরু করে। চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় এই মৌসুমে কোনো ধরনের বৈরী পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় ২ কোটি ২০ লাখ টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে। এত বড় উৎপাদন মৌসুমের তিন মাস পার হতেই চালের দাম বাড়ানোকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি বলে মনে করছেন অনেকে।