দেশের চলমান বন্যায় শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৮ জনের মৃতু্য হয়েছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বন্যা কবলিত ফেনী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সিলেট, লক্ষ্ণীপুর ও কক্সবাজার জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধকোটির বেশি। এসব জেলায় এখনো পানিবন্দি অবস্থায় আছে নয় লাখ ৭৯ হাজার ৯০১ পরিবার। বন্যার আগাম প্রস্তুতি না থাকায় ঘরবাড়ি, সহায়সম্বল ফেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে হয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষকে। ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্ণীপুর ও কুমিলস্নার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ সেই সুযোগও পাননি। এসব অঞ্চলে নিজ বাড়িতেই আটকা পড়েছেন লাখো মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যাকবলিত জেলাগুলোর মধ্যে ফেনী জেলার ৮০ শতাংশ পানির নিচে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে ছয় উপজেলা। সাড়ে ৯ লাখ গ্রাহক রয়েছেন বিদু্যৎহীন।
শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয়ের জন্য ৩ হাজার ৫১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট তিন লাখ এক হাজার ৯৯৩ জন মানুষ এবং ২১ হাজার ৬৯৫টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবার জন্য ৭৬৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যাকবলিত অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে পানি কিছুটা কমেছে। কিন্তু পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি বানভাসি মানুষের। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত থাকলেও দুর্গতদের কাছে তা পৌঁছানো যাচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে চলছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট।
'নৌকা না থাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে পারছি না'
ঢাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে গেলেও
নৌকা না থাকায় কুমিলস্নার বুড়িচংয়ের দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। এখন দুর্গত এলাকায় মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিশুদ্ধ খাবার পানি। ত্রাণ নিয়ে শনিবার সকালে বুড়িচংয়ের বাঁকশিমুল ইউনিয়নে মানিকপুর গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছায় স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল। এই গ্রামের নিকটে রেললাইনের পাশে অনেকই ত্রাণ নিয়ে এসেছেন। তারা সেখানেই নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
স্বেচ্ছাসেবকরা চাচ্ছিলেন, একটু ভেতরে গিয়ে বন্যায় পানিবন্দি মানুষদের কাছে খাবার ও পানি পৌঁছে দিতে। কিন্তু নৌকার না থাকার কারণে তারা তা পারেননি। ঢাকা বা আশপাশে থেকে যারা নৌকা নিয়ে আসতে পেরেছেন তারা হয়তো নিজেদের মতো করে দুর্গত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ দিতে পারছেন।
এই অবস্থায় অনেককে কলাগাছ এবং টিউব দিয়ে ভেলা বানিয়ে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করতেও দেখা গেছে। তবে এটি বেশ বিপজ্জনক বলেও জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলেন, যারাই ত্রাণ নিয়ে আসবেন তারা যেন অবশ্যই নৌকার ব্যবস্থা করে তবেই রওনা দেন। কারণ, নৌকা, ট্রলার বা স্পিডবোট না থাকলে দুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে না।
ঢাকার কাপ্তান বাজার থেকে যাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, 'একটা স্কুলে প্রায় ২০০ মানুষ আছেন। আমরা কাপ্তান বাজার থেকে ১৭০ প্যাকেট খাবার নিয়ে আসছি। কিন্তু নৌকার জন্য এত ভিতরে আমরা যেতে পারছি না। দুটি নৌকা পাইছি। তাদের বললাম নৌকা দেন, আমরা মানুষকে খাবার দিয়ে আসি। কিন্তু তারা নৌকা দিচ্ছেন না। কারণ, নৌকা নিয়ে তারা গবাদিপশুর খাবার সংগ্রহ করতে বের হয়েছেন। তারা বলছেন, আমাদের গরুকে খাওয়াতে হবে।'
মানুষের এখন খাবার পানির সবচেয়ে বেশি সংকট জানিয়ে ওই স্বেচ্চাসেবক বলেন, 'মানুষ বলতাছে, আমাদের খাবার দরকার নাই, আমাদের পানি দেন। আমাদের কাছে দেড়শ পাঁচ লিটারের পানির বোতল আছে। কিন্তু নৌকা না থাকার কারণে দিতে পারছি না। একটা ছোট নৌকা আমরা কাপ্তান বাজার থেকে নিয়ে আসছি। সেটা দিয়ে শুধু খাবার পাঠাতে পারছি। কিন্তু পানি নিতে পারতাছি না।'
স্থানীয়রা বলছিলেন, গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে এই এলাকা পস্নাবিত হয়েছে। রেললাইনের পশ্চিম দিকে ভুড়ভুড়িয়া গ্রামে অনেক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। কিন্তু সেখানে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছানো যাচ্ছে না। মানিকনগরের রেললাইনের আশপাশের প্রায় সব সড়কই পানিতে তলিয়ে আছেন। লোকজনকে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে দেখা গেছে।
কয়েকজন স্বেচ্চাসেবক শনিবার কুমিলস্না থেকে বুড়িচং এসেছেন ত্রাণ নিয়ে। দলের একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, 'এখানে একটা ব্যাপার হচ্ছে প্রচুর খাবার আসছে। কিন্তু খাবার মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য কোনো নৌকা নেই।'
শনিবার ফেনী সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ স্থানেই পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, চাষের জমি। অনেক গ্রামে বাড়িঘর খালি পড়ে আছে। বেশির ভাগ ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকেছে। কেউ কেউ দোতলা ও তিন তলায় আশ্রয় নিয়ে বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন খাবার ও পানির সন্ধানে।
বৃহস্পতিবার রাতে গোমতী ও কাকড়ি নদীর বাঁধ ভেঙে নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, বুড়িচং, চৌদ্দগ্রাম ও লাকসামসহ ১৪ উপজেলা পস্নাবিত হয়েছে। এতে কয়েক লাখ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদীতীরবর্তী বাসিন্দারা নির্ঘুম রাত কাটান। স্থানীয় হাজি বিলস্নাল হোসেন চেয়ারম্যান জানান, গোমতী বাঁধ ভেঙে প্রায় ২০০ পরিবার নিখোঁজ হয়েছে।
এদিকে বিদু্যৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকায় পরিবারের সদস্যদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনরা। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে ও ভেঙে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় পানিবন্দিদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীসহ সামাজিক সংগঠনগুলো কাজ করছে।
শনিবার বিকাল পৌনে ৪টায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিলস্নার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান বলেন, 'বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে গোমতী বাঁধের বুড়বুড়িয়া এলাকায় ৩০ ফুট ভেঙে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এখন সেই ভাঙন দেড়শ' মিটারের (প্রায় ৫০০ ফুট) বেশি। এতে তীব্র স্রোতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। নদীর পানি না কমলে এই বাঁধ মেরামত করা সম্ভব না। নদীর পানি যতদিন না কমবে ততদিন নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হতে থাকবে।'
প্রকৌশলী বলেন, 'শনিবার বিকাল পর্যন্ত গোমতীর পানি বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর শুক্রবার ১০৯ সেন্টিমিটার এবং বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। সে হিসাবে পানি কিছুটা কমেছে। আমরা চেষ্টা করছি, অন্য কোথাও যেন বাঁধ না ভাঙে সেদিকে লক্ষ্য রাখার।'
কুমিলস্না পলস্নীবিদু্যৎ সমিতি-২ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'পুরো বুড়িচং পানির নিচে। বিদু্যতের বেশিরভাগ মিটার পানিতে ভাসছে। এই মুহূর্তে বিদু্যৎসংযোগ সচল করলেই দুর্ঘটনা ঘটবে।'
জেলার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, লাকসাম, মনোহরগঞ্জসহ অন্তত ১২টি উপজেলায় বন্যার পানি কিছুটা কমলেও শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মিলছে না পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা। প্রতিটি এলাকাকে গুরুত্ব দিয়ে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।