১০ জেলায় পানিবন্দি ৩৬ লাখ মানুষ
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা
ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে :তথ্য উপদেষ্টা সচেতনভাবেই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে :রিজভী হ ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় ভয়াবহ বন্যা :জামায়াত বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যার কথা সঠিক নয় :ভারত গণঅধিকারের 'মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন' কর্মসূচি ফেনী প্রায় বিচ্ছিন্ন, বিপদে সাড়ে ৩ লাখ মানুষ উদ্ধার তৎপরতায় সেনাবাহিনী-বিজিবি ওর্ যাব
প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
ভারতের ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়া ও গত কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুর্যোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান বন্যায় দেশের ৮ জেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন দু'জন। একজন ফেনীতে, আরেকজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যাদুর্গত জেলা আটটি হলো- ফেনী, কুমিলস্না, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের জীবন রক্ষায় ও দুর্যোগ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ত্রাণ হিসেবে খাদ্য এবং নগদ অর্থের সর্বাত্মক প্রস্তুতি আছে। দ্রম্নত পানি নামলে পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করব। সেনা, নৌ, কোস্টগার্ড ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে নিয়োজিত করা হয়েছে। সংস্কার আন্দোলনের ছাত্ররাও উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রশাসন চেষ্টা করছে, সরকার চেষ্টা করছে যাতে মানুষের জীবন, জান-মাল, গবাদিপশু রক্ষা করা যায়। এটা আকস্মিক একটা। ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড যেটা বলে। কেউ কেউ বলছে আমাদের ওপারে, ওখান থেকে পানি এসেছে। ভারতীয় অঞ্চল থেকেও পানি নেমে এসেছে। বন্যা যে রকম প্রাকৃতিকভাবে হয়, দ্রম্নতই হয়েছে। গতকাল সকাল ও বিকাল থেকে দ্রম্নত পানি এসেছে যে অনেক উপদ্রম্নত এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সতর্কতা না দিয়ে বাঁধ খুলে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপেদেষ্টাসহ বিশিষ্টজনেরা। এছাড়া বাঁধ খুলে দেওয়ার খবরে ভারতের আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে :তথ্য উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, 'উজানের পানি বাংলাদেশে ধেয়ে এসে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে। আমরা আশা করব, দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে ভারত বাংলাদেশের জনগণবিরোধী এ ধরনের নীতি থেকে সরে আসবে। ভারতের এই নীতি নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও জনগণ ক্ষুব্ধ।' এ সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও কথা বলেন। এর আগে সকালে পাঁচ দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিস্নউটিএ) কার্যালয়ে অবস্থান নেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি জাতির ক্রান্তিলগ্নে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজে নেমে পড়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'সকল বাহিনী উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করুন। আপনাদেরকে যেন আর নির্দেশনা দেওয়া না লাগে।' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও সব শ্রেণির মানুষকে তিনি বন্যাদুর্গতের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বন্যাদুর্গত এলাকায় দ্রম্নত সরকারি-বেসরকারি স্পিড বোট পাঠানোসহ পাঁচ দফা দাবির বাস্তবায়ন না হলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিস্নউটিএ) কার্যালয় থেকে যাবেন না বলেও জানান তথ্য উপদেষ্টা। কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, 'অনতিবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি সব বোট দুর্গত এলাকায় নিয়োজিত করতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আহ্বান করে বলুন প্রধান উপদেষ্টা থেকে নির্দেশ আছে। এক ঘণ্টার মধ্যে কন্ট্রোলরুম চালু করুন।' জাতীয় সংকটের সময় দায়িত্ব পালনে যারা অবহেলা করছে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন বৃহস্পতিবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের বরাতে জানানো হয়েছে, বন্যাদুর্গত কয়েকটি উপজেলায় অপটিক্যাল ফাইবার ডেমেজ হওয়ার কারণে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিদু্যৎ বিচ্ছিন্ন আছে কয়েকটি জায়গায়। এসব এলাকায় জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। নেটওয়ার্ক একবারে বিচ্ছিন্ন হলে ১০টি ভিএসএটি প্রস্তুত আছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ফ্রি করতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। সচেতনভাবেই ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে : রিজভী বৃহস্পতিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের মানুষের বাঁচা-মরাকে কখনোই আমলে নেয় না। এ জন্য সচেতনভাবেই ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত কখনোই ন্যায়নীতির নির্দেশ গ্রাহ্য করেনি। তিনি বলেন, 'ভারতের ত্রিপুরাস্থ ধলাই জেলার গোমতী নদীর ওপর থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহে প্রতিবেশী দেশ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী পানি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের স্বার্থকে বিপন্ন করছে।' তিনি বলেন, 'বন্যাদুর্গত মানুষকে দ্রম্নত নিরাপদ স্থলে পৌঁছাতে সরকারসহ সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে উদ্ধারকাজের জন্য নেমে পড়তে হবে। এবারের বন্যা আড়াই দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ।' বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক বন্যার প্রকোপে বন্যা উপদ্রম্নত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসহ সমর্থকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দেশের সামর্থ্যবান ও ধনী ব্যক্তিদেরকেও বন্যার্তদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য আহ্বানও জানিয়েছেন। গণঅধিকার পরিষদের মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন কর্মসূচি বৃহস্পতিবার সকালে ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তির ন্যায্য হিস্যার দাবি এবং ডাম্বুর বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে গণঅধিকার পরিষদ। এ ছাড়া দলটি মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন কর্মসূচিও শুরু করেছে। রাজধানীর শাহজাদপুরে কনফিডেন্স সেন্টারের সামনে থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের হাতে বিভিন্ন পস্ন্যাকার্ড দেখা যায়। এতে লেখা রয়েছে- রক্ত দিয়া বানাইছি ঘর দিলিস্ন দেখায় পানির ডর, দিলিস্নর দাদাগিরি মানি না ইত্যাদি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ভারতের আগ্রাসন নীতির প্রতিবাদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ইবি প্রতিনিধি জানান, ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্যতা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ডুম্বুর ও গজলডোবা বাঁধ খুলে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া মোড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে বটতলায় এসে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলে 'বাবর আসছে, ভারত কাঁপছে' 'অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন', 'ভারতীয় দালালেরা, হুঁশিয়ার-সাবধান', 'দিলিস্ন না ঢাকা? ঢাকা, ঢাকা', 'ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন', 'পেতে চাইলে মুক্তি, ছাড়তে হবে ভারত ভক্তি', 'দালালি না রাজপথ, রাজপথ, রাজপথ'সহ নানা স্স্নোগান দিতে থাকেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সমাবেশ 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে'র ইবি শাখার সমন্বয় এস এম সুইট বলেন, 'আমাদের লড়াই-সংগ্রাম শেষ হয়নি। ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শহীদ আবরার ফাহাদ আমাদের এই কুষ্টিয়ার সন্তান। তিনি ভারতের এই বৈষম্যের প্রতিবাদে শহীদ হয়েছেন।' রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) রাবি প্রতিনিধি জানান, দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজশাহীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হন শিক্ষার্থীরা। এরপর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনগেটে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় সেখানে 'তুমি কে আমি কে, আবরার আবরার', 'ভারতের আগ্রাসন, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও', 'ভারতের দালালরা, হুঁশিয়ার সাবধান', 'আমার দেশ ডুবলে কেন, সরকারের কাছে জবাব চাই' ইত্যাদি স্স্নোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। রাবির কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মেশকাত চৌধুরী মিশু বলেন, 'বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে আন্তর্জাতিক নদীগুলো আছে তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে। ইতোপূর্বে ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে ভারতের যে অন্যায্য ও গোপন চুক্তিগুলো হয়েছিল তা দ্রম্নত বাতিল করতে হবে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো বাঁধ খুলে দেওয়া যাবে না।' আরবি বিভাগের শিক্ষক ড. ইফতিখারুল আলম মাসুদ বলেন, 'ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ভালো সম্পর্ক নেই। উগ্র, ফ্যাসিস্ট, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সেখানে শাসন করছে। তারা যেভাবে আমাদের শোষণ করেছে তার অন্যতম একটি হলো নদীর পানি শোষণ।' শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বুধবার রাতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শবি) শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়ক, গোলচত্বর ও ছাত্রী হল প্রদক্ষিণ করে আবার গোলচত্বরে এসে শেষ হয়। এ সময় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা 'দিলিস্ন না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা', 'আজকের এই দিনে, আবরার তোমায় পড়ে মনে', 'বন্যায় যখন মানুষ মরে, আবরার তোমায় মনে পড়ে', 'যদি চাও মুক্তি, ছাড়ো ভারত ভক্তি' প্রভৃতি স্স্নোগান দেন। সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দেলওয়ার হোসেন বলেন, 'ফ্যাসিস্ট সরকারের ১৫ বছরের দুঃশাসন আর নতজানু মনোভাব আমাদের ভারতের কাছে গোলাম করে রেখেছে। ভারতের আধিপত্যের কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন জনতার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সরকার ভারতীয় তাঁবেদারদের নয়। আমরা আশা করি, ভারত আগামীতে এমন ঘটনা ঘটাতে এক শ বার ভাববে।' আরেক সমন্বয়ক ফয়সাল হোসেন বলেন, 'ভারত যদি এ দেশের মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তাহলে এ দেশের মানুষ সেটা কখনোই মেনে নেবে না। আমাদের রক্ত এখন কারো দালালি করতে বলে না, আমাদের রক্ত এখন যুদ্ধ চায়।' বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) বুধবার রাত একটার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সামনে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। আবাসিক হল ও আশপাশের মেস থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে জড়ো হন। এরপর ক্যাম্পাস ও পরে মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় তারা 'ঢাকা না দিলিস্ন, ঢাকা, ঢাকা', 'ভারতের আগ্রাসন, ভেঙে দাও জনগণ' প্রভৃতি স্স্নোগান দেন। বিক্ষোভ শেষে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে সমাবেশ করেন। এ সময় তারা ভারতের দ্বিমুখী নীতির প্রতিবাদ জানান। রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন বলেন, 'বন্ধুত্ব হবে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে, অবশ্যই প্রভুত্বের ভিত্তিতে নয়। আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ দেওয়া চলবে না। এটা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটা ভারতের কৃত্রিমভাবে তৈরি করা বন্যা। আমরা হুঁশিয়ারি দিতে চাই, ছাত্র-জনতা এই বর্বরতা রুখে দেবে।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢা?বি) বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢা?বি) শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাদদে?শে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এ সময় শিক্ষার্থী?রা ভারতবি?রোধী নানা স্স্নোগান দেন। বি?ক্ষোভ সমা?বে?শে আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের বলেন, 'পাকিস্তান আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারিনি, ভারতও আমাদের দাবিতে রাখতে পারবে না। তারা অসময়ে ডুম্বুর ও গজলডোবা বাঁধ খুলে দি?য়ে?ছে। এর ফলে আমাদের কয়েকটা জেলা পস্নাবিত হয়েছে। আমাদের যখন পানির প্রয়োজন হয়, তখন তারা পানি দেয় না। অসময়ে আমাদের ভাসিয়ে দিচ্ছে। শেখ হাসিনার ভারত ঘেঁষার কারণে এ বাঁধ খুলে দিয়েছে মোদি সরকার। এর ফলস্বরূপ আজকের ছাত্রসমাজ শেখ হাসিনাকে লাল কার্ড দেখিয়েছে। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই, প্রভুত্ব নয়। অবিলম্বে ভারতের দ্বিমুখী নীতি বন্ধ করতে হবে।' ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত বলেন, 'আমার এলাকার মানুষ পানির ওপর মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমাদের ওপর বছরের পর বছর আগ্রাসন চালানো হয়েছে। আজকের ছাত্রসমাজ কোনো তামাশা মেনে নেবে না। ফেনীর এ বন্যা একটা রাজনৈতিক বন্যা। দেশের ছাত্রসমাজকে ফেনীর দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।' জামায়াতের উদ্বেগ দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। বুধবার পাঠানো ওই বিবৃতিতে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, 'ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় কুমিলস্না অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ভারত সরকার এই বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের কুমিলস্না অঞ্চলের মানুষদের পানিতে ডুবিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে। এ পর্যন্ত ৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভারত সরকারের এই অমানবিক কাজে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।' বিবৃতিতে তিনি পানিবন্দিদের দ্রম্নত উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দান এবং দুর্গত এলাকায় বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীসহ শুকনো খাবার, নগদ অর্থ, ওষুধ এবং চিকিৎসাসামগ্রী ও চিকিৎসক দল পাঠানোর জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানানোর পাশাপাশি বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বাঁধ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যার কথা সঠিক নয় :ভারত অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ভারতের ত্রিপুরায় ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশে এমন একটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এটা বাস্তবে সঠিক নয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতে গোমতী নদীর সংলগ্ন এলাকায় গত কয়েকদিনে চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাঁধের ভাটি এলাকার পানির কারণে বাংলাদেশের বন্যা হয়েছে। ডুম্বুর বাঁধ সীমান্ত থেকে অনেক দূরে, বাংলাদেশের ১২০ কিলোমিটার উজানে। প্রায় ৩০ মিটার উচ্চতার এই বাঁধের মাধ্যমে একটি বিদু্যৎ কেন্দ্র চলে। সেখান থেকে ত্রিপুরা হয়ে ৪০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে উজানে ১২০ কিলোমিটার নদীপথে তিনটি পানির পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকার কথা বলা হয়েছে বিবৃতিতে। যার মধ্যে অমরপুর স্টেশন থেকে দ্বিপক্ষীয় প্রটোকলের আওতায় বাংলাদেশকে বন্যার হালনাগাদ তথ্য দেওয়া হয়। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার তথ্য ২১ আগস্ট বিকাল ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টায় বন্যার কারণে বিদু্যৎ চলে যাওয়ায় যোগাযোগে সমস্যা তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে জরুরি তথ্য আদান-প্রদানের জন্য অন্যান্য উপায় ব্যবহার করে যোগাযোগ চালু রাখার চেষ্টা করার কথাও বলেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ে পৃথক কন্ট্রোলরুম চালু পাউবোর কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কন্ট্রোলরুম চালু করেছে নৌ পরিবহণ, পানিসম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয় দেশের আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। যোগাযোগের নম্বর -০২-৫৫১০১১১৫। নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বন্যা উপদ্রম্নত এলাকায় বন্যার্তদের সহায়তার জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে (কক্ষ নং-৮০১ (ক), ভবন নম্বর-৬, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা)। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের টেলিফোন নম্বর: +০২-৫৫১০০৮০৪ এবং মোবাইল নম্বর: +৮৮০১৭৫৭-০৭৮২৪৯। সচিবালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়েও কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। কন্ট্রোলরুমের মোবাইল নম্বর-০১৩১৮২৩৪৫৬০। সার্বিক বিষয়ে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা হিসেবে মনিটরিং করবেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. রবিউল আলম (মোবাইল- ০১৯৯২৪৩৯৩৪৭) বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা চলমান বন্যা পরিস্থিতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলায় স্থাপিত কন্ট্রোলরুম ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করে সমন্বিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন পেশ করবেন। বন্যার কারণে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে কন্ট্রোলরুম চালু করা হয়েছে। দশ জেলায় বানভাসি ৩৬ লাখ মানুষ চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১০ জেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এসব জেলায় ৩৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, ফেনী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫০ উপজেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন বন্যার কবলে পড়েছে। দেশে আট জেলার চার লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব আলী রেজা বলেন, 'আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন লোক এবং সাত হাজার ৪৫৯টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মোট ৪৪৪টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।' দুর্গতদের জন্য এক কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে জানিয়ে কে এম আলী রেজা বলেন, '১৩ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল ও ১১ হাজার বস্তা শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে।' তিনি জানান, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিচ্ছিন্নপ্রায় ফেনী, মহাবিপদে সাড়ে তিন লাখ মানুষ ফেনী প্রতিনিধি জানান, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদের পানিবন্দি সাড়ে তিন লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানোই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বন্যাকবলিতরা বলছেন, ফেনীতে এমন ভয়াবহ বন্যা আগে দেখেনি কেউ। প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফুলগাজী, পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদু্যৎ সংযোগ। বেশিরভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের ২৪টি বোট নিয়োজিত রয়েছে। তাদের পাশাপাশি বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরাও উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। বৃহস্পতিবার সকালে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ফেনীর মুহুরী নদীর পানি। এতে ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৫০টির বেশি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ছাগলনাইয়ার পাঠান নগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রামবন্যা কবলিত। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলি জমি। কিছু কিছু এলাকায় বানের পানি মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালও ছুঁয়েছে। ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রায়হান মেহেবুব বলেন, 'তিন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ, বেশিরভাগ এলাকায় পানির নিচে। এ ছাড়া ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঁইয়া উপজেলার অনেক এলাকাও বন্যাকবলিত।' তিন উপজেলায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, স্থানীয় লোকজন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা কাজ করছে।' বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৩০ হাজারের মতো মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার কথা জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া ফেনীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উঁচু ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পরশুরামের মির্জানগর এলাকা থেকে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ফেনী শহরের স্টেশন রোডের একটি হোটেলে এসে উঠেছেন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, 'রাতভর আতঙ্ক, মানুষের আর্তি আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ দেখেছি। প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কয়েকটি কাপড়চোপড় সম্বল করে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছি।' ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কবল থেকে লোকালয় রক্ষা করতে সোনাগাজী উপজেলার বড় ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মুহুরী রেগুলেটরের (জলকপাট) ৪০টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, জুলাই মাসের শুরুতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পানি বেড়ে ১৫ স্থানে ভাঙে। সেসব স্থানে জোড়াতালির মেরামতের পর চলতি মাসের শুরুতে বাঁধের আরও ১১ স্থানে ভেঙে গিয়ে পস্নাবিত হয় ১০০টির বেশি গ্রাম। যেখানে অবকাঠামো, ধান, ফসল ও মাছের ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় ৩০ কোটি টাকার বেশি। সেই ক্ষতি না পোষাতেই ১৫ দিনের মাথায় আবার বন্যা। গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টির সঙ্গে এবার নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ কয়েশ' কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফেনীর জেলা প্রশাসক সেলিনা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, 'বন্যাকবলিতদের উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি কাজ করছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও মাঠে আছে। ২ হাজারের বেশি পরিবারকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হচ্ছে। যেসব এলাকা বেশি পস্নাবিত হয়েছে, সেসব এলাকার মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।' খাগড়াছড়িতে ডুবেছে আশ্রয়কেন্দ্র, পাহাড়ধস এদিকে, তিন দিনের রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পস্নাবিত খাগড়াছড়ির আশ্রয়কেন্দ্রেও ঢুকে পড়েছে পানি। বৃহস্পতিবার সকালে জেলা শহর পস্নাবিত শুরু করেছে। পানি প্রবেশ করছে মেরুং ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্রেও। পস্নাবিত হয়েছে দীঘিনালার তিন ইউনিয়নের ৫০ গ্রাম। একইসঙ্গে ঘটছে পাহাড়ধসের ঘটনা। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মাইনী নদীর পানি বাড়তে থাকায় এর মধ্যেই ডুবে গেছে জেলার বিভিন্ন সড়ক, কৃষি জমি ও পুকুর। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। পৌর শহরের বাসিন্দা আরাফুল ইসলাম বলেন, 'এত পানি গত ১০ বছরেও দেখিনি। শহরের মধ্যে সাধারণত পানি উঠে না। এবার শহরের প্রধান সড়কগুলোও ডুবে গেছে।' আরেক বাসিন্দা মাঈন উদ্দিন বলেন, 'টানা এক সপ্তাহের বৃষ্টি আর নদীর পানি বেড়ে পৌরসভার গঞ্জপাড়া, অপর্ণা চৌধুরী পাড়া, রাজ্যমণি পাড়া, কালাডেবা, বটতলী, ফুটবিল, শান্তিনগর, মুসলিম পাড়া পুরোপুরি পানির নিচে।' পাহাড়ি ঢলে হেডকোয়ার্টার এলাকায় দীঘিনালা-লংগদু সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর পানি বেড়ে পস্নাবিত হয়েছে দীঘিনালার মেরুং, বোয়ালখালি ও কবাখালি ইউনিয়নের ৫০ গ্রাম। ডুবে গেছে মেরুং বাজার। মেরুং ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ঘনশ্যাম ত্রিপুরা বলেন, 'বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মাইনী নদীর পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রও ডোবা শুরু হয়েছে। মেরুং বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলা ডুবে গেছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া ২৯টি পরিবারকে বিদ্যালয় ভবনে দ্বিতীয় তলায় তুলে দেওয়া হয়েছে।' খাগড়াছড়ির প্রথম শ্রেণি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে। মৌলভীবাজারে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। গত তিন দিনে জেলার সাত উপজেলায় ৩৭টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বড়লেখা, জুড়ী, রাজনগর, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, রাজনগর, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ২১২টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরে জেলার রাজনগর উপজেলার কদমহাটা এলাকায় মনু নদীর বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। ফলে ভোররাত থেকে মৌলভীবাজার-রাজনগর-ফেঞ্চুগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার-কুলাউড়া-বড়লেখা সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে, বুধবার রাতে কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের বেশ কয়েকটি স্থানে ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যাক্রান্ত এসব এলাকার লোকজন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। তবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজন খোঁজ না নেওয়ায় চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, সাত উপজেলায় বন্যাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক লাখ ২২ হাজার ৬৮৭ জন এবং ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন চার হাজার ৩২৫ জন। পৌরসভা ও ইউনিয়ন মিলে ৩৭টি এলাকায় বন্যায় পস্নাবিত হয়েছে ২১২টি গ্রাম। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৩৫ মেট্রিক টন চাল এবং সাত উপজেলায় ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, জেলার জুড়ী নদে ১৯৩ সেন্টিমিটার, ধলাই নদে ৩০ সেন্টিমিটার, মনু নদীতে চাঁদনীঘাটে ১১৮ সেন্টিমিটার ও রেলওয়ে ব্রিজে ৮৫ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়াও মৌলভীবাজার শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা নদী পানি বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে বৃহস্পতিবার সকালে বিভিন্ন আবহাওয়া সংস্থার বরাতে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিতে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিলস্না ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলে বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরে উন্নতি হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এসব নদীর পানি সমতলে কমে যেতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।