আদানিকে বিশেষ সুবিধা দিতেই দেশে বাড়ানো হয় বিদু্যতের দাম
প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
রেজা মাহমুদ
চলতি বছরের শরুতে আইএমএফের ভর্তুকি তুলে নেওয়া শর্তে বিদু্যতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরেই গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে গ্রাহক ও পাইকারি পর্যায়ে অস্বাভাবিক হারে বিদু্যতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদু্যৎ ক্রয়ে প্রশ্নবিদ্ধ বিভিন্ন চুক্তিই এজন্য দায়ী বলে জানান বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে আদানির বিদু্যৎ আমদানি শুরুর পরই দেশের বাজারে বেড়ে যায় বিদু্যতের দাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী, বিগত সরকারের আমলে দেশীয় উৎপাদকের পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানি বিশেষ করে ভারতের আদানি পাওয়ারের বিদু্যৎ আমদানির চুক্তির পরই বিদু্যতের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে ভারতের অন্যান্য উৎসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে বিদু্যৎ আমদানি চুক্তি করে বাংলাদেশ।
এর আগে ২০১৩ সালে ভারত থেকে বিদু্যৎ আমদানি শুরু হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধির আগ পর্যন্ত প্রতি ইউনিট ৬ টাকা দরে আমদানি করা হয়েছিল। এরপর ২০১৭ সালে আদানি গ্রম্নপের সঙ্গে বিদু্যৎ ক্রয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। জনসম্মুখে চুক্তির ধারাগুলো প্রকাশ ছাড়াই বাংলাদেশ ২০২৩ সাল থেকে আদানি থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট করে বিদু্যৎ ক্রয় করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিটের দাম ধরা হয় ১৪ টাকার বেশি। অন্যদিকে একই সময় দেশে উৎপাদিত অন্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বিদু্যতের
\হপ্রতি ইউনিটের গড় ব্যয় ছিল ৮ টাকা। কিন্তু আদানির বিদু্যৎ যোগ হওয়ার পরই প্রতি ইউনিটের গড় দাম ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ টাকা ৬১ পয়সা করা হয়।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ ২০২৩ সালে আদানির থেকে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা (বা এক ইউনিট) বিদু্যৎ ১৪ টাকা ২ পয়সায় কিনেছিল। যদিও একই সময় ভারতের ইলেকট্রিসিটি এক্সচেঞ্জ মার্কেট থেকে ৭ টাকা ৮৩ পয়সা দরে আরও ১১০০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ কিনেছিল বাংলাদেশ।
এদিকে ২০১৯ সালেও প্রতি ইউনিট বিদু্যতের গড় দাম ছিল ৫.৯১ পয়সা, তবে ডলারের দাম বৃদ্ধি ও জ্বালানির দামের কারণে ২০২১-২২ সময়কালে বিদু্যতের গড় দাম দাড়ায় ৮ টাকা ৮৪ পয়সা। কিন্তু গত ৩ বছরে দেশের বিদু্যতের উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে প্রতি ইউনিটের দাম ১১.৩ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। মূলত আদানিসহ বিভিন্ন উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদু্যৎ ক্রয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চুক্তির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ ছাড়া আদানি পাওয়ারের বিদু্যতের জ্বালানি অর্থাৎ কয়লার দাম নিয়েও প্রশ্ন ছিল বিভিন্ন মহলে। দেশের অন্যান্য তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্রের তুলনায় আদানিতে ব্যবহৃত কয়লার দাম ধরা হয় প্রায় দ্বিগুণ। যেখানে একই ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রের প্রতিটন কয়লার দাম ২৪০ ডলার সেখানে আদানি প্রতিটন কয়লার দাম ধরা হয় ৪০০ ডলার। এ নিয়ে বিদু্যৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আপত্তি জানায় এবং কয়লার দাম পুনর্নির্ধারণের জন্য বলা হয়। এমনকি ক্রয়চুক্তি সংশোধনের অনুরোধ করেন তারা। কিন্তু এসব উপেক্ষা করেই আদানির নির্ধারিত কয়লার দামেই বিদু্যৎ কেনে সরকার।
এ বিষয়ে তৎকালীন বিদু্যৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, 'বিদু্যতের দাম পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্টে (পিপিএ) যা ছিল, সেটিই হবে। চুক্তিতে যা ছিল, সেটিই থাকবে। দাম ওঠানামা করবে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামের ওপর'।
এদিকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন বিদু্যৎ উৎপাদনকারীদের কাছে বিপিডিবির বকেয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদানিসহ ভারতীয় আমদানি উৎসগুলোর পাওনা ৫ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। যা পরিশোধে বিপিডিবিকে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত ২৯ মে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন (৭০ কোটি) ডলারের বকেয়া বিদু্যৎ বিল দ্রম্নত পরিশোধের জন্য তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে দেখা করে তাকে অনুরোধ করেন আদানি গ্রম্নপের পরিচালক প্রণব আদানি।
জানা গেছে হাসিনা সরকারের পতনের পরই আদানি ভারতের অভ্যন্তরে বিদু্যৎ সরবরাহ শুরু করছে। যদিও এই বিদু্যৎ কেন্দ্রটি শুধু বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য অনুমোদন দেয় ভারত সরকার। তবে ৫ আগস্টের পর স্থানীয় বাজারে বিদু্যৎ বিক্রির অনুমোদন দেয় ভারতের বিদু্যৎ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদু্যতের রপ্তানি বিল বকেয়া থাকলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের দেশে বিদু্যৎ বিক্রি করতে পারবে। ভারতে আদানিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যে কিনা শুধু রপ্তানির জন্য অনুমোদন পায়।