স্থানীয় সরকার বিভাগকে পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে দেশের ৮৮৮ জনপ্রতিনিধিকে একযোগে অপসারণ করে সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটিসহ ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়র, ৬০ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ৩২৩ পৌরসভার মেয়র এবং ৪৯৩ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়। তবে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের এখনই অপসারণ করা হচ্ছে না, পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সোমবার এ সংক্রান্ত পৃথক আদেশ জারি করেছে স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। আদেশে বলা হয়, যেসব জেলায় বিভাগীয় শহর পড়েছে, সেখানে প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারদের (সার্বিক)। বাকি জেলায় দায়িত্ব পালন করবেন জেলা প্রশাসকরা। আর পৌরসভার ক্ষেত্রে সাত পৌরসভায় আগে থেকেই প্রশাসক ছিলেন, তবে তাদের সরিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৪৯৫টি উপজেলায় এখন থেকে দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা।
সোমবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, 'স্থানীয় সরকার বিভাগকে পরিচ্ছন্ন করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হয়েছে।'
পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা বলেন, 'পুরনো শাসকের সঙ্গে সম্পর্কিত কাউকে না রাখার যে দাবি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে এই রদবদল। পুরো স্থানীয় সরকার বিভাগকে পরিচ্ছন্ন করার একটা প্রক্রিয়া।'
এ এফ হাসান আরিফ বলেন, 'এই সরকার রুটিন সরকার নয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে একটা বিপস্নবের মাধ্যমে এই সরকার এসেছে। আমরা তাদেরই প্রতিনিধি। ছাত্র-জনতা যে দাবি-দাওয়া কার্যকরের জন্য আমাদের ওপর বিশ্বাস রেখেছে, সেটার প্রতিনিধি হিসেবে আমরা কাজ করছি।'
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে হাসান আরিফ বলেন, 'ইউনিয়ন পরিষদে এখন হাত দিচ্ছি না। যাচাই-বাছাই করে দেখা যাক, সেখানে কার্যক্রম কী রকম আছে, যদি পরে প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনের তাগিদে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়, সেটি নেওয়া হবে। আর জন্ম-মৃতু্য নিবন্ধনসহ অন্যান্য যে কাজগুলো দৈনন্দিন
করতে হয়, সেগুলো যেন চালু থাকে এবং গ্রামীণ পর্যায়ের উন্নয়ন কার্যক্রম যেন চলমান থাকে, সে জন্য প্রথম দিকেই স্থানীয় যারা সরকারি কর্মচারী আছেন, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।'
সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, 'প্রশাসক থাকলে কাউন্সিলররা দায়িত্ব পালন করবে কি করবে না, সেটা এখন তাদের ব্যাপার। মূল হচ্ছে মেয়র-চেয়ারম্যানের জায়গায় প্রশাসক দায়িত্ব পালন করবে।'
১২ সিটি করপোরেশন
ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সোমবার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিলস্না, রংপুর, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়।
এতে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪' এর ধারা ১৩'র ক অনুযায়ী ওইসব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের নিজ নিজ পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
একই সময় ওই ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রের শূন্যপদে ১২ জন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ও নারায়ণগঞ্জের প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তিনজন অতিরিক্ত সচিবকে।
কুমিলস্না সিটি করপোরেশনের প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ পলস্নী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালককে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ সিটির মেয়র পদে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে স্ব স্ব বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারদের।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের আইনের ২৫ (ক) এর উপধারা (১) অনুযায়ী পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের প্রশাসক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সব জেলা পরিষদ
দেশের তিন পার্বত্য জেলা বাদে সব জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
এর মধ্যে যেসব জেলায় বিভাগীয় শহর পড়েছে, সেখানে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক)। বাকি ৫৩ জেলায় দায়িত্ব পালন করবেন জেলা প্রশাসকরা। স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
আরেক প্রজ্ঞাপনে নাটোর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান খানের মৃতু্যতে তার পদটি শূন্য ঘোষণা করা হয়।
অপর এক প্রজ্ঞাপনে ৬০টি জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান অপসারণের কথা জানানো হয়। জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এর ১০ (খ) ধারা অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
বিশেষ পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা শীর্ষক অধ্যাদেশের ১০ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইনের অন্যান্য বিধানে কিংবা আপাতত বলবত অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার অত্যাবশক বিবেচনা করিলে বা জনস্বার্থে, সকল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা সদস্যদের অপসারণ করিতে পারিবে।'
৩৩০ পৌরসভা
দেশের ৩৩০ পৌরসভাতেই প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সহকারী কমিশনার (ভূমি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন পদবির সরকারি কর্মকর্তা এই দায়িত্ব পেয়েছেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এর আগে ৩২৩ পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করা হয়। বাকি সাত পৌরসভায় আগে থেকে প্রশাসক ছিল, যাদের সরিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের তিনটি প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
নির্বাচিত মেয়রদের অপসারণে সংশোধিত স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর ৩২ (ক) ধারা প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
বিশেষ পরিস্থিতিতে মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা শীর্ষক অধ্যাদেশের ৩২ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইনের অন্যান্য বিধানে কিংবা আপাতত বলবত অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার অত্যাবশক বিবেচনা করিলে বা জনস্বার্থে, সকল পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলরদের অপসারণ করিতে পারিবে।'
৪৯৫ উপজেলা পরিষদ
দেশের ৪৯৫টি উপজেলাতেই সংশ্লিষ্ট ইউএনওকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। এর আগে ৪৯৩ জন চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়। আর খুলনার কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান জিএম মোহসিন রেজা মারা যাওয়ায় শূন্য ঘোষণা করা হয় তার পদটি। স্থানীয় সরকার বিভাগের তিন প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের অপসারণে উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এর ১৩ (ঘ) ধারা প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
বিশেষ পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা শীর্ষক অধ্যাদেশের ১৩ (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইনের অন্যান্য বিধানে কিংবা আপাতত বলবত অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার অত্যাবশক বিবেচনা করিলে বা জনস্বার্থে, সকল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বা অন্যান্য সদস্যদের অপসারণ করিতে পারিবে।'
এর আগে বিশেষ পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ এবং প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রেখে পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশনের আইন সংশোধনের আলাদা আলাদা অধ্যাদেশ শনিবার রাতে জারি করে অন্তর্র্বর্তী সরকার।