উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গত কয়েক বছর ধরে সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খেলেও অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ একশ' গুণ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। দেশে শত শত একর জমি, বিপুল সংখ্যক ফ্ল্যাট ও শিল্প-কারখানার মালিক হওয়ার পাশাপাশি অনেকে বিদেশেও একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে।
এতদিন ভিআইপি এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস না পেলেও ছাত্র-জনতার গণঅভু্যত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকেই এখন এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। নখ-দন্তবিহীন দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে।
এরই মধ্যে গত রোববার ৪১ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপির দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীর আবেদন করেন। অভিযোগের সঙ্গে ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন দুদক চেয়ারম্যানের কাছে ৪১ জনের তালিকা ও তাদের সম্পদ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেন। এতে তিনি গত ৫ থেকে ১৫ বছরে মন্ত্রী ও এমপি থাকা অবস্থায় এই ৪১ জনের সম্পদ বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরেন। এর একদিন পর গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগ সরকারের
এই মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুর্নীতির অনুসন্ধানের ওই তালিকা থাকা ৪১ জনের মধ্যে ২৩ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং ১৮ জন সংসদ সদস্য।
এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন বলেন, 'সাবেক মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে। দুদক কাউকে ছাড় দেবে না। কমিশনে অভিযোগ করে থাকলে কমিশন সেটি তার বিধি অনুযায়ী দেখবে, এটা কমিশনের নৈমিত্তিক কাজ।'
দুদকের ঊর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে ৪১ মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, তিনজন পরিচালকের নেতৃত্বে আলাদা তিনটি টিম এই অনুসন্ধানের কাজ করবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেনের দুদকে পাঠানো আবেদনে যেসব সাবেক মন্ত্রীর নাম রয়েছে তারা হলেন- টিপু মুনশি, নসরুল হামিদ বিপু, সাধন চন্দ্র মজুমদার, আনিসুল হক, ডা. দীপু মনি, ডা. এনামুর রহমান, জাহিদ মালেক, তাজুল ইসলাম, জুনাইদ আহমেদ পলক, মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ফরিদুল হক, গোলাম দস্তগীর গাজী, ইমরান আহমদ, জাকির হোসেন, কামাল আহমেদ মজুমদার, জাহিদ আহসান রাসেল, নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, শাহজাহান খান, হাছান মাহমুদ, কামরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু ও মহিবুর রহমান।
সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে এই তালিকায় রয়েছেন, বেনজীর আহমেদ (ঢাকা-২০), সরওয়ার জাহান (কুষ্টিয়া-১), শরিফুল ইসলাম জিন্না (বগুড়া-২), শহিদুল ইসলাম বকুল (নাটোর-১), শেখ আফিল উদ্দিন (যশোর-১), ছলিম উদ্দীন তরফদার (নওগাঁ-৩), কাজী নাবিল আহমেদ (যশোর-৩), এনামুল হক (রাজশাহী-৪), মামুনুর রশিদ কিরন (নোয়াখালী ৩), কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (খাগড়াছড়ি), মেহের আফরোজ চুমকি (গাজীপুর-৫), কাজিম উদ্দিন আহমেদ (ময়মনসিংহ-১১), স্বপন ভট্টাচার্য (যশোর-৫), আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (পটুয়াখালী-২), নূরে আলম চৌধুরী (মাদারীপুর-১), আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন (জয়পুরহাট-২), শেখ হেলাল উদ্দিন (বাগেরহাট-১), জিয়াউর রহমান (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২)।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এর আগে দুই ডজন সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী ও পুলিশের অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে তাদের সম্পত্তি, নামে-বেনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকার পরিমাণ খোঁজ নিচ্ছে দুদক। এর মধ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) তাদের সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল, মেয়ে নাফিসা কামাল, ফেনী-২ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদসহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে।
এ ছাড়া অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে ডিবির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। একই অভিযোগে ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করছে এ সংস্থাটি। অন্যদিকে লন্ডনে বাড়ি নির্মাণের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আস্থা অর্জনে নির্ভয়ে কাজ করতে চায় দুদক। এতে দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবাই একযোগে দুর্নীতি নির্মূলে কাজ করবে। এজন্য বিগত সরকারের দুর্নীতিবাজ শীর্ষ আমলা-মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।
এর আগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসে নিয়োগ বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান টিমে আরও রয়েছেন, দুদকের উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদিন, সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম ও মো. নাছরুলস্নাহ হোসাইন।
এ ছাড়া অনুসন্ধান শুরু হয়েছে আলোচিত সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপসহ চার সাবেক এমপি, সমালোচিত ব্যবসায়ী এস আলম, ব্যবসায়ী সাইফুল আলম (এস আলম) ও পদ্মা ব্যাংকের পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
দুদক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) একাধিক প্রভাবশালীর সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এসব তথ্য পাওয়া গেলে আরও প্রভাবশালীর দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করতে পারে দুদক।