রাষ্ট্র মেরামতে সংস্কার চায় বিএনপিও
প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে চায় বিএনপি। দলটি মনে করে, এই সরকারের নীতিনির্ধারকরা দেশপ্রেমিক। তাদের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রধান উপদেষ্টা উত্থাপিত ৫ খাতে সংস্কার চায় বিএনপিও।
রোববার বিদেশি কূটনীতিকদের সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমের আমূল সংস্কারের মাধ্যমে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে যতদ্রম্নত সম্ভব একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
এত কিছুর সংস্কার সময় সাপেক্ষ। এজন্য বিএনপি এ নিয়ে আপত্তি করতে পারে, অনেকের এমন ধারণা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি চায় প্রয়োজনীয় সংস্কার। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম একটি সুন্দর বাসযোগ্য দেশ পেতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. ইউনূস যে খাতগুলোয় সংস্কারের কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। এর মধ্য দিয়ে জন-আকাঙ্ক্ষার যথার্থ প্রতিফলন হয়েছে।
বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর সোমবারও দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকের আলোচনায় ৫ খাতে সংস্কারর ইসু্যটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন আছে। রাষ্ট্রের কাঠামোতে গুণগত পরির্তন না এলে পরবর্তী সরকারকে বেশ চাপে পড়তে হবে। ফলে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারের পক্ষে থাকা উচিত। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অযথা সময়ক্ষেপণ করলে সমালোচনামুখর হবে। এর আগে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করার পক্ষে মত দিয়েছেন প্রায় সব সদস্য।
এদিকে সোমবার এক আলোচনা সভায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শক্ত করে দাঁড় করিয়ে রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, 'যারা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালাচ্ছেন তারা রাজনীতি বোঝেন না, তারা রাজনীতি করেন না। তারা একটা অল্প সময়ের জন্য এসে এই রাষ্ট্রকে যে ধ্বংস করে দিয়েছে সেটাকে একটু টেনে তোলার চেষ্টা করছেন। এখন এই সময় কোনো নেতিবাচক কথা বলে বা কোনো নেতিবাচক কাজ করে আমাদের এই প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করে দেওয়া একেবারে ঠিক কাজ হবে না। আমরা দেখি, আমরা সহায়তা করি। ইনশালস্নাহ অতীতের মতো এবার আমরা সফল হবো। আমরা একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ গঠন করতে পারব এবং সেটা সরকার গঠন করবে।'
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে বিদেশে পালিয়ে গেলেও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনো স্বৈরাচারের বীজ রয়ে গেছে। কারণ পুরো প্রশাসন দলীয়করণ করা হয়েছে। বিগত সরকার সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উত্তরণ এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার। বিএনপি বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রের এই সংস্কার চেয়েছে। এজন্য গত বছর রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখাও ঘোষণা করে দলটি। তাই রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে বিএনপি। সংস্কারের এই উদ্যোগে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত তারা। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এ ব্যাপারে মতামতও দেবে।
বিএনপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে যে মনোযোগ দিয়েছে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিল রেখে সেটা সহজে, চমৎকারভাবে করতে পারবে এবং এ কাজে সফল হবে। যেটা নানা চাপের কারণে রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে অনেক সময় করা সম্ভব নাও হতে পারে। সে কারণে রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের প্রতিটি উদ্যোগের সঙ্গে তারা থাকবে। অবশ্য আগামীতে সরকার গঠন করলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করার অঙ্গীকার রয়েছে বিএনপির।
দলীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, পুনরায় যদি রাষ্ট্রের আরও সংস্কারের প্রয়োজন হয়, সেটাও সময় সময় সরকারের নজরে আনবে বিএনপি। একই সঙ্গে সরকারের কর্মকান্ড এবং গতিবিধিও পর্যবেক্ষণে রাখবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার যদি কোনো ভুলত্রম্নটি করে কিংবা জন-আকাঙ্ক্ষার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়, সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের রাশ টেনে ধরবে, রাজপথে প্রতিবাদ জানাবে।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে গত বছরের জুলাইয়ে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছিল বিএনপি। দলটি তখন জানিয়েছিল, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি 'জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার' প্রতিষ্ঠা করা হবে। ওই সরকারই রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
দফাগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল, একটি 'সংবিধান সংস্কার কমিশন' গঠন করে সব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ পর্যালোচনাপূর্বক তা রহিত কিংবা সংশোধন করা হবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। সব মত ও পথের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক 'রেইনবো নেশন' প্রতিষ্ঠা করা হবে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় 'নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার' ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে। পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে 'উচ্চ-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা' প্রবর্তন করা হবে। 'প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন' গঠন করে প্রশাসন সংস্কার ও পুনঃগঠন করা হবে। আইসিটি অ্যাক্ট-২০০৬, সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট-১৯৭৪, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করা হবে।