মালয়েশিয়া শ্রমবাজার নিয়ে গঠিত চক্রে ঢুকে বাণিজ্য করা চার সাবেক সংসদ সদস্যের (এমপি) বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চক্রটি দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে।
দুদক সূত্র জানায়, সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি অভিযোগ অনুসন্ধান করবে। অভিযোগের বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে দুদক।
এই চক্রের চার সাবেক সংসদ সদস্য হলেন- নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ ও আ হ ম মুস্তাফা কামাল। চক্রে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠানের একটি সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে, অন্যটি মেয়ে নাফিসা কামালের নামে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তারা সবাই আত্মগোপনে আছেন। এর মধ্যে আ হ ম মুস্তাফা কামাল সিঙ্গাপুরে বলে জানা গেছে।
এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে দুদকের উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম জানান, মূলত চারজন সংসদ সদস্যই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। এর মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। চক্রগুলো সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে ঘিরে। দেশটির শ্রমবাজারকে পুঁজি করে
সিন্ডিকেটগুলো বেআইনিভাবে রমরমা জনশক্তি রপ্তানি করেছে। দেশটিতে যাওয়া বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। চার সংসদ সদস্যই মূলত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমন অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করতে তিন সদস্য বিশিষ্ট দুদক একটি অনুসন্ধান কমিটি করেছে।
কমিটির প্রধান করা হয়েছে মোহাম্মদ নূরুল হুদাকে। ইতোমধ্যে কমিটি অনুসন্ধান শুরু করেছে। সিন্ডিকেটের হোতা ছাড়াও সহযোগীদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। মূলত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুদকে জমা পড়া অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পরই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম আরও জানান, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে 'অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ' ও মেয়ে নাফিসা কামালের নামে 'অরবিটালস ইন্টারন্যাশনাল' নামে দুটি রিক্রুটিং এজেন্সি খোলা হয়। যার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। তার স্ত্রী ও কন্যার নামে প্রতিষ্ঠিত এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় গেছেন ৯ হাজার ৮৬১ জন লোক। বিদেশে শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেট গঠনের মূল কারিগরও ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই সিন্ডিকেট যখন গঠিত হয়, তখন তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন।
অভিযোগ পর্যালোচনায় আরও জানা গেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নিজাম উদ্দিন হাজারী বিদেশে লোক পাঠাতে 'স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড' নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন। লাইসেন্স পাওয়ার পর স্বচ্ছতার সঙ্গে কর্মী পাঠানো শুরু করে। যেজন্য তেমন কর্মী পাঠাতে পারছিল না। লাইসেন্স পাওয়ার পর সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। অথচ শ্রমবাজার সিন্ডিকেটে যোগ দেওয়ার পর গত দেড় বছরে শুধু মালয়েশিয়াতেই প্রায় ৮ হাজার কর্মী পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি দেশটিতে সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠানো এজেন্সির তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান চতুর্থ স্থানে।
তিনি আরও জানান, ২০১৫ সালে 'ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল' নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠান করেন সাবেক এমপি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। মালয়েশিয়ায় এককভাবে লোক পাঠানোর দিক থেকে প্রথম অবস্থানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি মধ্যপ্রাচ্যেও প্রায়ই আড়াই হাজারের মতো লোক পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে। মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটে ঢোকার পর এজেন্সিটি একাই ৮ হাজার ৫৯২ জন কর্মী পাঠানোর ছাড়পত্র নিয়েছে।
দুদক কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম জানান, 'আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল' নামে একটি রিক্রটিং এজেন্সি খোলেন আরেক এমপি বেনজীর আহমেদ। প্রথম দিকে স্বচ্ছতার সঙ্গে বিদেশে কর্মী পাঠালেও পরে সিন্ডিকেটে যোগ দেয় তার প্রতিষ্ঠান। স্বচ্ছতার সঙ্গে জনবল পাঠানোর সময়কালে মাত্র ২৩৮ জন লোককে বিদেশ পাঠিয়েছে বলে রেকর্ডপত্র সূত্রে জানা গেছে।
অথচ মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটে যোগ দেওয়ার পর দেশটিতে লোক পাঠানোর দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রিক্রুটিং এজেন্সিটির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ কর্মী। সিন্ডিকেট গড়ে তোলার সময় বেনজীর আহমেদ ছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি।
দুদক সূত্রে আরও জানা গেছে, তিন সংসদ সদস্য এবং একজন সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের অনেক কাউন্সিলরও শ্রমবাজারে জড়িত। শ্রম খাতের নতুন নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে বিদেশে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশসহ মোট ১৪টি দেশ কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে এমন সিন্ডিকেট গড়ে তুলে লোক পাঠানোর কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এমনকি এমন কোনো চক্রও নেই বাকি ১৩টি দেশে। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। সিন্ডিকেটে জড়িত থাকা এজেন্সিগুলো বসে বসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে অন্তত দেড় লাখ টাকা করে 'চক্র ফি' বা কমিশন পেত। অন্য এজেন্সির মধ্যে ঐশী ইন্টারন্যাশনাল, নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড, পিআর ওভারসিজ, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ, বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড ও অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সির নাম জানা গেছে।
দুদক কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বলছেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার জনপ্রতি ৭৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। অথচ প্রতিজন কর্মীর কাজ থেকে রিক্রটিং এজেন্সিগুলো নানাভাবে ছল ছাতুরি ও নানাভাবে হয়রানি করে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নিয়েছে। দেড় বছরে অন্তত সাড়ে ৪ লাখ লোক পাঠিয়েছে এজেন্সিগুলো। সে হিসেবে এসব এজেন্সিগুলো নিয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকা। সরকার নির্ধারিত ফি-এর চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা হিসেবে 'চক্র ফি' বা কমিশন বাবদই চক্রগুলো হাতিয়ে নিয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।
হাতিয়ে নেওয়া টাকা, প্রতিষ্ঠানসহ নানা বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বলেন, অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে মামলা দায়ের ও অভিযুক্তদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ করার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে। যদিও এসব বিষয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।