বিবিসির অনুসন্ধান

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতে ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে উগ্রবাদীরা

প্রকাশ | ১৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অনেক হিন্দু পরিবার নিরাপত্তা চেয়ে সমাবেশও করেছে
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে 'হিন্দু গণহত্যা' চলছে দাবি করে অনেক ভিডিও শেয়ার করা হচ্ছে। যারা এইসব শেয়ার করছেন, তাদের অগ্রভাগে রয়েছে উগ্র ডানপন্থিরা। বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ 'বিবিসি ভেরিফাই' এবং 'গেস্নাবাল ডিসইনফরমেশন টিম' সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন সব ভিডিও যাচাই করতে গিয়ে দেখেছে যে, সেগুলোর অনেকগুলোই আসলে ভুয়া খবর। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সম্প্রতি বাংলাদেশে বড় ধরনের বিক্ষোভে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় বাংলাদেশের ছয় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতাকর্মীদের অনেকে হামলার শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয়ই রয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অতি ডানপন্থি (হিন্দুত্ববাদী) দলের নেতাকর্মীরা ওইসব হামলার ঘটনাকে রাজনৈতিক না রেখে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে মনে \হকরেন ফ্যাক্ট চেকাররা। ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, 'বাংলাদেশের ইসলামপন্থিরা' একটা মন্দিরে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যে, ভিডিওটি আসলে চট্টগ্রামের। সেখানে 'নবগ্রহ মন্দিরে'র পেছনে অবস্থিত আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। মন্দিরের কর্মকর্তা স্বপন দাস জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগের ওই কার্যালয়ে হামলা হয়। ওই সময় কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিল বাইরে বের করে এনে আগুন লাগানো হয়েছিল। স্বপন জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় মন্দিরের কোনো ক্ষতি হয়নি। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, মন্দিরের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য ২৪ ঘণ্টাই মন্দিরটি পাহারা দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের 'হিন্দু ক্রিকেটার' লিটন দাসের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। পোস্টে লেখা হয়েছে, 'কট্টর ইসলামপন্থিরা' বাড়িটিতে আগুন দিয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, পোস্টের বাড়িটি ক্রিকেটার লিটন দাসের নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজার। ভারতে যারা এসব পোস্ট শেয়ার করছেন, তাদের অনেকেই উগ্রডানপন্থি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থক। বাংলাদেশের মুসলমানদের নাম জড়িয়ে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর এমন ঘটনা এখন ভারতের বাইরে এমনকি যুক্তরাজ্যেও ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'এক্স' এ (সাবেক টুইটার) টমি রবিনসন নামে অ্যাকাউন্ট চালানো উগ্র ডানপন্থার সমর্থক স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেনন যাচাই না করেই এক নারীর এমন একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন। এর শিরোনামে ইয়াক্সলি-লেনন 'হিন্দু গণহত্যা' শব্দটি উলেস্নখ করেছেন। কিন্তু যাচাই করে গিয়ে বিবিসি পুরোপুরি ভিন্ন একটি ঘটনা পেয়েছে। ঘটনাস্থল ঘুরে এসে বিবিসিকে একজন শিক্ষার্থী জানিয়েছে, জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে ঘটনাটি ঘটেছিল। বিষয়টি নিয়ে অনেক আগেই একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মূল ভিডিওটি আগস্টের ছয় তারিখে প্রকাশ করা হয়। এরপর স্থানীয় শিক্ষার্থীদের একটি দল ওই নারীকে সাহায্য করতে গিয়েছিল। বিবিসিকে শিক্ষার্থীরা আরও বেশকিছু ছবি এবং ভিডিও দিয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে বাড়িটির ভিতরে অবস্থিত মন্দিরটি অক্ষত রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে বিবিসি। তারাও জানিয়েছে যে, হামলার ঘটনাটি ধর্মীয় কারণে হয়নি। তবে এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টমি রবিনসন নামে পরিচিত। উগ্র ডানপন্থি এই ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের দাঙ্গার সময় বিভ্রান্তিকর পোস্ট করার জন্য ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশে বার্তাসংস্থা এএফপি'র ফ্যাক্ট-চেকার কদরউদ্দিন শিশির বিবিসিকে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর রাজনৈতিক কারণে হওয়া হামলাগুলোকে ভারতের কট্টরপন্থি সমর্থকরা 'ধর্মীয়' হিসাবে ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নামে দুটি সংগঠন দাবি করেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের অর্ধশতাধিক জেলায় সংখ্যালঘু মানুষের ওপর দুই শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। সংগঠনগুলো জানায়, সরকার পতনের পর অন্তত পাঁচজন হিন্দু নিহত হওয়ার খবর তারা পেয়েছেন, যাদের মধ্যে দু'জন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে যে, সহিংসতায় আওয়ামী লীগের ৫০ জনেরও বেশি মুসলিম নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে ভারতে যখন ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে, তখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মুসলমান শিক্ষার্থীরাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দিচ্ছেন।