ঢাকার আদালতের এজলাস কক্ষ থেকে একে একে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে লোহার খাঁচা। শুক্রবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের দুজন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত কক্ষ থেকে লোহার খাঁচা সরানো হয়।
এজলাস কক্ষ থেকে লোহার খাঁচা সরিয়ে ফেলাকে নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে উলেস্নখ করেছে এ বিষয়ে হাইকোর্টে হওয়া রিটের পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির।
বিচারালয়ের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে শুক্রবার (১৬ আগস্ট) ঢাকার আদালতের কয়েকটি এজলাস কক্ষ থেকে সরিয়ে ফেলা হয় লোহার খাঁচা। গণপূর্ত বিভাগের লোকজন লোহার খাঁচা সরানের কাজটি করছেন। পর্যায়ক্রমে সব আদালতের খাঁচা সরিয়ে ফেলা হবে।
দেশের অধঃস্তন আদালত কক্ষে থাকা লোহার খাঁচা অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী। সে রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ৪ ফেব্রম্নয়ারি রুলসহ আদেশ দিয়েছিলেন।
রিটের পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, সারাদেশে অধঃস্তন আদালত কক্ষে কতগুলো লোহার খাঁচা রয়েছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে হাইকোর্ট তার রুলে আদালত কক্ষে লোহার খাঁচার পরিবর্তে কাঠগড়া পুনঃস্থাপনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছিলেন। এছাড়া
আদালত কক্ষে লোহার খাঁচা বসানো কেন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১, ৩২ ও ৩৫ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল।
ঢাকার আদালতের লোহার খাঁচা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১২ জুন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'আজ আমরা অনেকক্ষণ খাঁচার (আসামির কাঠগড়া) মধ্যে ছিলাম। আমি যতদূর জানি, যত দিন আসামি অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছে তত দিন তিনি নিরপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবেন। একজন নিরপরাধ নাগরিককে শুনানির সময় লোহার খাঁচায় (আসামির কাঠগড়া) দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এটা আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক। এটা গর্হিত কাজ। এটা কারও ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না। একটা পর্যালোচনা হোক। একটা সভ্য দেশে কেন একজন নাগরিককে শুনানির সময় পশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? যেখানে তিনি তখনো দোষী সাব্যস্ত হননি।'
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, একটি সভ্য রাষ্ট্রের আদালতে লোহার খাঁচা থাকতে পারে না। আগে কখনো লোহার খাঁচা ছিল না। কয়েক বছর ধরে লোহার খাঁচা বসানো হয়েছে। অবিলম্বে আদালত থেকে লোহার খাঁচা তুলে নেওয়ার দাবি জানান এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
আদালতে লোহার খাঁচায় আসামি রাখাকে সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'বিচারের মুখোমুখি কোনো আসামির সঙ্গে সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের চেতনার পরিপন্থি কোনো আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়। একজন আসামিকে লোহার খাঁচায় ঢোকানো কিংবা ঢুকতে বাধ্য করা অমানবিক। এটি সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি।'
সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদের (ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস-আইসিসিপিআর) ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কাউকে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি দেওয়া যাবে না। আইসিসিপিআরের অনুচ্ছেদ ১৪(২) অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত প্রত্যেকের আইন অনুযায়ী দোষী প্রমাণের আগপর্যন্ত নির্দোষ বলে গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।
কী করা উচিত
সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবী জানিয়েছেন, একটা সময় পৃথিবীর অনেক দেশেই ফৌজদারি মামলার আসামিদের আদালতকক্ষের লোহার খাঁচায় রাখা হতো। তবে আইসিসিপিআরের চেতনার পরিপন্থি হওয়ায় অনেক দেশই লোহার খাঁচায় আসামি রাখার পদ্ধতিতে থেকে সরে এসেছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ কিংবা আমেরিকার ফৌজদারি আদালতে লোহার খাঁচায় আসামি রাখা হয় না।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, বাংলাদেশের ফৌজদারি আদালতগুলোয় আসামি রাখা হতো কাঠের তৈরি কাঠগড়ায়। সংবিধান অনুযায়ী, বিচারের মুখোমুখি কোনো আসামির সঙ্গে নিষ্ঠুর কিংবা অমানবিক আচরণ করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু কোনো আসামিকে লোহার খাঁচায় রাখা অমানবিক বিষয়।
লোহার খাঁচায় আসামি রাখার পদ্ধতি তুলে দিয়ে আগের মতো কাঠগড়ায় তাদের রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক। সদ্য অবসরে যাওয়া জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ সাইফুজ্জামান বলেন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর কোনো সভ্য রাষ্ট্রের আদালতের ভেতর লোহার খাঁচা নেই। অবিলম্বে আদালত থেকে লোহার খাঁচা তুলে নেওয়ার মত দেন তিনি।
উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়া
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে সব অমানবিক, ফ্যাসিবাদী উপকরণ উপড়ে ফেলা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক এবং অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
শনিবার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আসিফ মাহমুদ 'আদালতের এজলাস কক্ষ থেকে সরানো হচ্ছে লোহার খাঁচা' এই শিরোনামের একটি সংবাদ শেয়ার করেন।
এ সময় আসিফ মাহমুদ আরও লেখেন, 'ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের দেওয়া মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বারবার যেতে হয়েছে এই লোহার খাঁচায়। শুনানি-হাজিরায় ছোট্ট একটা খাঁচায় আমাদের ২৪ জনকে ঢোকাতো।'