চার জেলায় এমপিসহ আসামি প্রায় ২ হাজার
হাসিনা ও কাদেরকে আসামি করে বগুড়ায় হত্যা মামলা দায়ের
প্রকাশ | ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
সদ্য ক্ষমতাচু্যত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে আসামি করে বগুড়ায় শিক্ষক হত্যা হামলা দায়ের হয়েছে। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে আ'লীগের ১০১ জন নেতাকর্মীকে। এছাড়া আওয়ামী লীগের আরও ৮২ জনের নামে পৃথক আরেকটি মামলা হয়েছে। এদিকে দেশের আরও তিন জেলায় সাবেক সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ৩৫১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পৃথক মামলা দায়ের হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে বাধা, হামলা, হত্যা ও বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনায় এসব মামলা দায়ের করা হয়। জেলাগুলোর মধ্যে পাবনার ঈশ্বরদীতে এমপি গালিবসহ আসামি করা হয়েছে ৭১ জন, মাগুরায় সাবেক এমপিসহ আসামি ১৭২ জন এবং শেরপুরে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় দু'টি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৫ জনকে। এসব মামলায় দেড় হাজারের বেশি অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিনে ও রাতে এসব মামলা দায়ের হয়েছে।
হত্যা মামলার আসামি হাসিনা-কাদের :স্টাফ রিপোর্টার ও বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষক সেলিম হোসেনের নিহতের ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে নিহত সেলিম হোসেনের বাবা সেকেন্দার আলী বগুড়া সদর থানায় মামলাটি দায়ের করেন বলে জানিয়েছেন বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউলস্নাহ।
সেলিম হোসেন (৩৫) বগুড়ার শিবগঞ্জের পীরব ইউনিয়নের পালিকান্দা গ্রামের বাসিন্দা এবং কাহালু উপজেলার মুরইল লাইট হাউজ স্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন।
গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শহরের সাতমাথায় সেলিম হোসেনকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার সহকর্মীরা সে সময় অভিযোগ করেছিলেন, আওয়ামী-যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাকে হত্যা করেছে।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে করা হত্যা মামলায় শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের ছাড়াও আওয়ামী লীগের দু'জন সাবেক সংসদ সদস্য, পাঁচজন উপজেলা চেয়ারম্যান, দুই মেয়র, বগুড়া পৌরসভার আট কাউন্সিলর, ১০ জন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ২৫ জনপ্রতিনিধিসহ মোট ৯৯ জনের নাম উলেস্নখ করা হয়। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ৩৫০ জনকে।
মামলার এজাহারে উলেস্নখ করা হয়েছে, ৪ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে বগুড়া শহরের সাতমাথায় স্টেশন সড়কে আইএফআইসি ব্যাংকের সামনে আওয়ামী লীগের সাবেক ওই দুই সংসদ সদস্যসহ সাত নেতার নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
এ সময় তারা হাতবোমা ও পেট্রোল বোমা হামলা চালান। হামলায় শিক্ষক সেলিম হোসেন রক্তাক্ত হন। পরে বগুড়া পৌরসভার কাউন্সিলর আবদুল মতিন সরকার ও আমিনুল ইসলাম রামদা দিয়ে কুপিয়ে এবং কাউন্সিলর আরিফুর রহমান হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে তাকে জখম করেন। পরে অন্য হামলাকারীরা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তার মৃতু্য নিশ্চিত করেন।
বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউলস্নাহ বলেন, শিক্ষক সেলিম হোসেনকে হত্যা মামলা ছাড়াও শ্রমিক দল অফিস পোড়ানোর ঘটনায়ও মামলা করা হয়েছে।
ওই মামলায় শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুল আলম বাদী হয়ে জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার লিটনকে প্রধান আসামি করে মোট ১৪১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বলে জানান ওসি।
এছাড়া বগুড়ায় বিএনপি কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৮২ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে এ মামলায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার নেই।
বৃহস্পতিবার জেলা বিএনপির সহ দপ্তর সম্পাদক রহিমা খাতুন মেরি বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলাটি করেন বলে জানিয়েছেন সদর থানার ওসি সাইহান ওলি উলস্নাহ।
মামলার এজাহারে উলেস্নখ করা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় বগুড়া শহরের নওয়াববাড়ি সড়কে জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলা চালান।
এ সময় কার্যালয়ের তালা ভেঙে চেয়ার-টেবিল, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন আসবাব ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য দলীয় কার্যালয়ের সামনে কয়েকটি হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল বাসেত বলেন, 'যারা এত দিন ক্ষমতার অপব্যবহার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দিয়ে নির্যাতন করেছে, ছাত্র আন্দোলন দমাতে যারা হামলা, মামলা ও খুন-হত্যায় ইন্ধন দিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে একটি মামলা হয়েছে। আরও মামলার প্রস্তুতি চলছে।'
সদর থানার ওসি সাইহান ওলি উলস্নাহ বলেন, 'আসামিদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে।'
ঈশ্বরদীতে ৭১ নেতাকর্মীর নামে মামলা
ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কর্মীদের মিছিলে গুলি বর্ষণ, হামলা চালিয়ে মারপিট ও গুলিবিদ্ধ করার ঘটনায় পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) সাবেক এমপি গালিবুর রহমান শরীফকে প্রধান করে আওয়ামী লীগের ৭১ জন নেতাকর্মীর নাম উলেস্নখ করে অস্ত্র ও হত্যার চেষ্টা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে নামীয় আসামির তালিকায় নাম নেই ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌরসভার সাবেক মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক মাসুদ রানাসহ আওয়ামী লীগের সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে থাকা অনেক প্রভাবশালী নেতার।
বৃহস্পতিবার রাতে ঈশ্বরদী পৌর শহরের শৈলপাড়ার মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে গুলিবিদ্ধ মোঃ নজরুল ইসলাম (৪৪) বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আর ৮০-৯০ জনকে। ঈশ্বরদী থানায় মামলা নং-১০, তাং-১৫/৮/২৪।
আজ (শুক্রবার) দুপুরে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মো.মনিরুল ইসলাম।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার একদফা আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশের অন্য এলাকার মতো গত ৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঈশ্বরদীতেও ছাত্র-জনতা শহরের ২নং ওয়ার্ড পশ্চিম টেংরী কাচারীপাড়া আল-হেরা জামে মসজিদ মোড় পাকা রাস্তার ওপর মামলার বাদী, তার বন্ধুরাসহ ছাত্র-জনতা জমায়েত হতে থাকেন। এই সময় এমপি গালিবুর রহমান শরীফের নেতৃত্বে আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র পিস্তল, বন্দুক, বোমা, ধারালো অস্ত্র, রামদা, হাসুয়া, চাপাতি, ছুরি, হকস্টিক, লোহার পাইপসহ তাদের ওপর হামলা চালায়। আসামিদের নিক্ষেপ করা ককটেল ও গুলিতে বাদী ও তার বন্ধু রাসেদুল ইসলাম রিপন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এ হামলায় আরও অনেক ছাত্র-জনতা আহত হয়েছিলেন।
মামলার বাদী নজরুল ইসলাম বলেন, 'ঘটনার দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এমপি গালিবুর রহমান শরীফ নিজে হুকুম দিয়ে ছাত্র-জনতার উপর ককটেল বোমা নিক্ষেপ ও গুলি বর্ষণ করিয়েছেন। হামলা চালিয়ে পিটিয়ে অনেকজনকে আহত করিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়ি, জমি, পুকুর, ব্যবসা প্রতিষ্টানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও দখল করেছেন। আমি তাদের দ্রম্নত গ্রেফতারসহ কঠোর শাস্তির দাবি করছি।'
ঈশ্বরদী থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, 'মামলায় পাবনা-৪ এর সাবেক এমপি গালিবুর রহমান শরীফকে প্রধান আসামী করে ৭১ জনের নামে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ও হত্যার চেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৮০-৯০ জনকে আসামি করা হয়েছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আসামিরাও সবাই আত্মগোপন করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।'
মাগুরায় হত্যা মামলায় আসামি ১৭২ জন
মহম্মদপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শিক্ষার্থী সুমন নিহতের ঘটনায় মাগুরা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডক্টর বীরেন শিকদার, তার ভাই বিমলেন্দু শিকদার, মহম্মদপুর উপজেলা আ'লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান এবং সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল সিদ্দিকী লিটনসহ দলের ১৭২ নেতাকর্মীকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ৫০০/৬০০ জনকে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নিহত শিক্ষার্থী সুমনের বাবা কান্নুর রহমান বাদী হয়ে মামলাটি রুজু করেন।
এজাহারে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট সকালে মহম্মদপুর উপজেলা সদরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয় উপজেলার শ্রীপুর-বালিদিয়া গ্রামের কান্নুর রহমানের কলেজ পড়ুয়া ছেলে সুমন (১৮)। এদিন দুপুরে মহম্মদপুর থানার অদূরে গুলিতে নিহত হয় সে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই এদিন রাতে বালিদিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন গোরস্তানে মরদেহ দাফন করা হয়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল মানান দাবি করেছেন 'আমাকেসহ আমাদের দলীয় নেতাকর্মীদেরকে হ্যারাজ করার জন্য মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।'
এ বিষয়ে মহম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ঠাকুর দাশ মন্ডল বলেন, 'বাদীর স্বাক্ষরিত কম্পিউটার টাইপকৃত এজাহার অনুযায়ী মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
শেরপুরে শিক্ষার্থী হত্যায় দুটি মামলা
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গাড়ি চাপায় ও গুলিতে ৩ শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। ১২ আগস্ট সোমবার নিহতদের স্বজনরা বাদী হয়ে সদর থানায় ওই দুটি মামলা করেন। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সদর থানার ওসি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।
এর মধ্যে গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী সবুজ হত্যা মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য বিলুপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের শেরপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ছানুয়ার হোসেন ছানু, শেরপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এডি এম শহিদুল ইসলাম, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হুমায়ুন কবীর রুমানসহ ২৫ জনকে স্বনামে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া গাড়িচাপায় ২ শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে এসব মামলায় এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
শেরপুর সদর থানার ওসি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, ওইসব ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।